১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির কারণ উল্লেখ কর
ভূমিকা : ১৯৪৭ সালের ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তি একটি যুগান্তরকারী ঘটনা। বস্তুত ১৯৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ বেনিয়া শাসকগোষ্ঠী এ উপমহাদেশে যে ঔপনিবেশের ভিত গড়েছিল তা প্রায় ২০০ বছর টিকে ছিল। তখন থেকেই ভারতীয় মুসলমানদের ভাগ্যের আকাশে রাজনৈতিক সংকট ও দুর্যোগের ঘনঘটা নেমে আসে। কিন্তু এ ক্ষমতার পালাবদলে হিন্দুদের কোনো অসুবিধা হয়নি। এরপরও ব্রিটিশরা হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে সৃষ্টি সাম্প্রদায়িকতা। যার ফলে সুদীর্ঘ ২০০ বছর তারা উপমহাদেশ শাসন করতে কোনো বেগ পেতে হয়নি । মূলত হিন্দু-মুসলমানদের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবে সর্বশেষ ভারত দ্বি-খণ্ডিত হয়। নিম্নে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির কারণসমূহ আলোচনা করা হলো-
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির কারণ উল্লেখ কর
১. সিপাহী বিপ্লব বা বিদ্রোহঃ বিগত ১০০ বছরের ইংরেজদের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। কিন্তু ইংরেজ সরকার সিপাহী বিদ্রোহে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় । তারা সিপাহি বিপ্লবের জন্য মুসলমানদেরকে এককভাবে দায়ী করে এবং মুসলমানদের উপর এ জন্যে অথ্য নির্যাতন আরম্ভ করে।
২. আলীগড় আন্দোলনঃ সিপাহী বিপ্লবের পর থেকে মুসলমানদের উপর যে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়, তার প্রতিকারে স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলমানদের পাশে দাড়িয়ে তাদের রক্ষার্থে চেষ্টা চালান। তিনি ইংরেজদের বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, মুসলমানরা প্রকৃত পক্ষে সিপাহী বিদ্রোহের জন্য দায়ী নন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, ৬। মুসলমানদের উন্নয়নের জন্য ইংরেজি শেখা প্রয়োজন। তাই তিনি মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার জন্য উৎসাহিত করেন।
আরো পড়ুন: মৌলিক গণতন্ত্র কি ?
৩. ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনঃ গোল টেবিল বৈঠকের সুপারিশ ক্রমে ভারতের মাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানে ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসন আইন প্রবর্তন করে। এ আইন কেন্দ্রে দ্বৈতশাসন প্রবর্তন করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। যার কারণে ভারতবাসী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন আরো সোচ্চার হয়।
৪. মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাঃ কংগ্রেস কর্তৃক মুসলিম বিরোধী কার্যকলাপের মোকাবেলা করার জন্য মুসলমানগন একটি মুসলিম জাতীয়তাবাদী সংগঠনের প্রয়োজন অনুভব করেন। দীর্ঘ দিন যাবত চেষ্টা-প্রচেষ্টা করার পর অবশেষে ১৯০৬ সালে মুসলমানরা ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ” নামে একটি মুসলিম রাজনৈতিক দল গঠন করতে সমর্থ হন।
আরো পড়ুন: সামরিক শাসন বলতে কি বুঝ।
৫. বঙ্গভঙ্গ রদঃ ১৯০৫ সালে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য লর্ড কার্জন পূর্ব বাংলা ও আসামকে নিয়ে একজন ডেপুটি গর্ভনরের অধীনে একটি পৃথক প্রদেশ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা ব্যক্ত করলে কংগ্রেসের কট্টরপন্থী মুসলিম বিরোধীরা ঘোর আপত্তি তোলেন । এবং বঙ্গভঙ্গের পর হিন্দুদের কঠোর সমালোচনার মুখে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হন ব্রিটিশ সরকার ।
৬. লক্ষ্মৌ চুক্তিঃ মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যকার বিবাদমান বৈরিতার অবসান ঘটে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের মাধ্যমে । এ আন্দোলনের নীতিমালা ১৯১৩ সালে মুসলিম লীগের কাউন্সিল সভায় গ্রহণ করা হয়। যার ফলে সম্ভব হয়েছিল ১৯১৬ লক্ষ্মৌতে সাক্ষরিত হয়েছিল মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে এক যৌথ চুক্তি। যা ভারত স্বাধীনতার অন্যতম কারণ।
৭. সাইমন কমিশনারঃ ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অন্যতম একটি ধারা হলো ব্রিটিশ সরকার ১০ বছর পর এই আইনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য একটি কমিশন প্রেরণ করবেন। কিন্তু ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ সরকার জ সাইমনের নেতৃত্বে ভারতে একটি প্রতিনিধ দল প্রেরণ করেন। এ প্রতিনিধ দলে কোন ভারতীয় সদস্য রাখা হয়নি। যার কারণে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ তা বর্জন করে। এ কমিশন ভারত বিভক্তির পথকে অনেকটা সুগম করে দেয়।
আরো পড়ুন: সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।
৮. নেহেরু রিপোর্টঃ মতিলাল নেহেরুর সভাপতিত্বে ভারতীয় কংগ্রেস ভারতীয় একটি সংবিধান রচনা করার জন্য কমিটি গঠন করে। এ কমিটি তিন মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভারতের জন্য এক শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ রিপোর্ট ব্রিটিশ সরকারের নিকট পেশ করা হলে ব্রিটিশ সরকার এ রিপোর্টকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি । এ কারণে ভারতীয় জনগণ অসন্তুষ্ট হয়।
৯. জিন্নাহর চৌদ্দ দফাঃ নেহেরু রিপোর্টের বিপরীতে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের স্বার্থ সম্বলিত তার প্রখ্যাত চৌদ্দ দফা কর্মসূচী ১৯২৯ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে ঘোষণা করেন। ফলে ভারত এক রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশের উদয় হয় । যা ভারত বিভক্তিতে আরো ত্বরান্বিত করে।
১০. ১৯৩৭ সালের নির্বাচনঃ ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিমরা বাংলা ও পাঞ্জাবের এবং কংগ্রেস প্রায় সর্বত্রই সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে । যার ফলে হিন্দুরা সর্বত্র বিস্তার করতে চাইলে বাংলা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে হিন্দু-মুসলিম আলাদা রাষ্ট্রের অপরিহার্যতা দেখা দেয়। যার সর্বশেষ পরিণতি ভারত বিভক্তি ।
১১. ভারত ছাড় আন্দোলনঃ ১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট ব্রিটিশ সরকারের বৈরী মনোভাব এবং মুসলিম লীগের দ্বি- জাতিতত্ত্বে বিচলিত হয়ে গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ শাসনের পতনের উদ্দেশ্যে ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু করে । যার পরিণতিতে ভারত স্বাধীনতা।
১২. মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার ব্যর্থতাঃ ঐক্যবদ্ধ ভারত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৬ সালের ১৬মে ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধান করে ব্রিটিশ তিন প্রভাবশালী মন্ত্রী একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। যা মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা নামে পরিচিত । কিন্তু মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের দ্বন্দ্বের কারণে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আর হয়ে উঠেনি । যা ভারত বিভক্তি অনিবার্য করে তুলে।
১৩. ভারত স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭: ১৯৪৬ সালে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার ব্যর্থতার ব্রিটিশ সরকার ভারত বিভক্তি করতে ব্যর্থ হয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা আইন পাস করা হয়। এই আইন অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং ভারত বিভক্ত হয়ে যায়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন, বিশ্ব মানচিত্রে দুটি নতুন রাষ্ট্রের স্থান করে দেয় । যার ফলে ভারতের ইতিহাস ভেঙ্গে দ্বি-খন্ডিত হয়ে যায়। অবসান হয় ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের। মূলত ব্রিটিশ জুলুম, অত্যাচার এই উপমহাদেশে তাদের পতন ডেকে আনে। ফলে একপর্যায়ে তারা ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং বিভক্ত হয় পুরো ভাতবর্ষ।
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url