স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পরিধি
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির উদ্ভবের পর হতেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সূচনা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের পরিধি সে প্রেক্ষিতেই বিচার্য। কিন্তু এখানেই এর শেষ বেঁধে দেওয়া যায় না বরং এর জন্য একটু হলেও পিছনে তাকাতে হবে। বিশেষকরে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব তন্মধ্যে অন্যতম। একটি দেশের ইতিহাসকে সঠিক ও যথাযথভাবে তুলে ধরার স্বার্থেই সেখানকার ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, ভাষা, সংস্কৃতি ও মানবধারা সম্পর্কে আলোকপাত কর প্রয়োজন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পরিধির অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে এগুলো এসেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পরিধি
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের বিষয়বস্তু ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে: ও পরিধিকে নিম্নোক্ত :
১. ভূপ্রকৃতি : ভূপ্রকৃতি হলো কোন এলাকার মাটির গঠন তথা সে এলাকার মাই আঠালো কী বালুকাময়, পাহাড়ি না সমতল ইত্যাদি বিষয়গুলো। আর পরিবেশ হলো প্রাকৃতিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সমাহার যার মধ্যে রয়েছে আবহাওয়া, জলবায়ু, তবা ভৌগোলিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য। আর সামাজিক পরিবেশ হলো মানুষের জীবনধারা। সংস্কৃতি ও সভ্যতা আর এসবই ইতিহাসের বিষয়বস্তু। বাংলাদেশের ইতিহাস আলোচনায় দেশ ও জনগোষ্ঠীর অধ্যায়ে প্রথমে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনায় দেখানো হয়েছে নাতিশীতোষ্ণ এতদঞ্চলের ভূপ্রকৃতি একদিকে যেমন উর্বর তেমনি সমতল। কিছু উচ্চভূমি থাকলেও তা উত্তর থেকে দক্ষিণে ক্রমশ ঢালু হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখার মিলনবিন্দু হওয়ায় এখানে বিভিন্ন ঋতু বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। প্রায় সব ধরনের ফসল হওয়ার মতো জলবায়ুর প্রভাব এ অঞ্চলে বিদ্যমান। ফলে এলাকার মানুষ অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ও সদ্ভাবাপন্ন। মরুভূমির রুক্ষতা বা পাহাড়ি এলাকার হিংস্রতার পরিবর্তে এলাকার লোকজনের মানসিক চরিত্র অপেক্ষাকৃত সুখী ও সহযোগিতামূলক। মানুষ খুব বেশি উচ্চাভিলাষী হওয়ার পরিবর্তে স্বাধীনচেতা ও স্বল্পে তুষ্ট চরিত্রের দেখা যায়।
আরও পড়ুন: লাহোর প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কি ছিল ?
২. জনগোষ্ঠীর পরিচয়: ভূখণ্ডের প্রকৃতির পাশাপাশি জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ ছাড়া ইতিহাসের আলোচনা পূর্ণাঙ্গ হয় না। তাই অনিবার্যভাবেই বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। বাঙালি হচ্ছে সংকর জাতি। বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর মিথস্ক্রিয়ায় বাঙালি জাতি ও তাদের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। মিশ্র নরগোষ্ঠীর কারণে এখানে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যতা বিদ্যমান। দ্রাবিড়দের তথা অস্ট্রালয়েডদের উন্নত চাষাবাদ সংস্কৃতির উপর হামলা চালিয়ে ককেশয়েড আর্যরা তাদের প্রভাব বিস্তার করে। পরে এদেশে মুঘলরা, মুসলিম ধর্মপ্রচারকরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছে, তুর্কি, পারস্য আক্রমণ হয়েছে, ইউরোপীয় উপনিবেশ তৈরি হয়েছে, মঙ্গোলদের সাথে মিশ্রণ হয়ে এদেশের জনগণ এক মিশ্র চরিত্রের নরগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে। মূলত এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও শান্ত স্বভাবের মানুষের প্রতি লোভী হয়ে বাইরের আক্রমণ বারবার হয়েছে। মানুষও তাদের প্রতি খুব একটা বিদ্রোহী হয়নি যতক্ষণ না তাদের নিজস্ব স্বাধীনতা ও কর্মকাণ্ডের উপর আঘাত করা হয়েছে। ফলে এদেশের মানুষ একদিকে যেমন নরগোষ্ঠীগত ভিন্নতা পেয়েছে তেমনি তারা সাংস্কৃতিক ভিন্নতাও বহন করে।
৩. ভাষা: ভাষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা মূলত ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর এবং এটি বিবর্তন পেরিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। এ ভাষাটি নরগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির মতোই বিভিন্ন মিশ্রণ পেরিয়ে একটি মিশ্র কিন্তু সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে যেমন আছে সংস্কৃতির প্রাধান্য, তেমনি আছে ইংরেজি, ফারসি, আরবি, উর্দু, তুর্কি, পর্তুগিজ ইত্যাদি ভাষার সংমিশ্রণ। এ মিশ্রণের ফলে বাংলা ভাষা কিন্তু তার স্বাতন্ত্র্য হারায়নি বরং বিভিন্ন ভাষার ছোঁয়া ও সংমিশ্রণে হয়েছে আরো সমৃদ্ধ ও সহজবোধ্য। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে বাংলা ভাষার উৎপত্তি, বিবর্তন ও উৎকর্ষ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: লাহোর প্রস্তাবের মূলধারা সমূহ উল্লেখ কর ?
৪. ধর্ম ও সংস্কৃতি: ধর্ম ও সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপরও প্রভাব ফেলেছে। বিভিন্ন জাতির শাসনে ও নরগোষ্ঠীর মিশ্রণ এদেশের জনগণ একটি মিশ্র সংস্কৃতি পেয়েছে, যেখানে সহনশীলতা একটি বড় উপাদান। একসময় এদেশ শাসন করতো হিন্দু নরপতিরা, পরবর্তীতে বৌদ্ধরা, পরবর্তীতে আবার হিন্দুরা, আবার মুসলিমরা, আবার খ্রিষ্টানরা, আবার মুসলিমরা ফলে ধর্মীয় ভেদাভেদের চাইতে এদেশের মানুষ সবার সাথে একটি সহনশীলতার সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যেখানে ধর্মীয় উগ্রতার স্থান নেই। এখানে একদিকে যেমন পহেলা বৈশাখ উদ্যাপিত হয়। আবার হিন্দু, মুসলিম উভয়ের বিয়েতেই আলপনা ও গায়ে হলুদের সংস্কৃতি বর্তমান। তাই বলা যায় বাঙালি মানস ধর্মীয় মৌলবাদের বিপরীত। অভিন্ন বাংলার প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার একটি আলাদা সত্তা পাওয়া যায় এবং এর জন্য একাধিক কারণকেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। সংস্কৃতির একটি উপাদান ধর্ম, সে প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলায় মুসলিম আধিক্য এবং পশ্চিম বাংলায় হিন্দু আধিক্য ও সংস্কৃতির চর্চা দেখতে পাওয়া যায়। বলা হয় প্রতি ১৩ মাইল পর পর সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের প্রভাব কমবেশি হয়ে যায়। হতে পারে সে উপাদান ভাষা, ধর্মীয় আচার, জীবনাচারের রীতি, লোকাচার, লোকরীতি, প্রথা বা অন্য কোন উপাদান। তাছাড়া পশ্চিম বাংলা প্রাচীন আমল থেকে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে একটু দূরে হওয়ায় তা শাসকবর্গের সাথে থাকার ও শাসনের একটি চরিত্র পেয়েছে। কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর সে সৌভাগ্য হয়নি বা সেটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে কারণ ১৬০৪ সাল থেকে ঢাকাকে বারবার রাজধানীর মর্যাদা দেওয়া হলেও তা ছিনিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রও বারবার হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বঙ্গভঙ্গের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এদিক থেকে বলা যায় পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে স্বকীয় সত্তার বিভিন্নতা বর্তমান। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয় সম্পর্কে আলোচনার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে এদেশের মানুষের ধর্ম ও সংস্কৃতির বর্ণনা স্থান পেয়েছে।
৫. পাকিস্তানের অভ্যুদয়: পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, কাঠামো ও শ্রেণি চরিত্রের মধ্যেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বীজ নিহিত। এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা সম্ভব হবে না। তাই চাসঙ্গিকভাবে পাকিস্তানের অভ্যুদয় সম্পর্কে আলোচনা তারা দেয়েছে। আমরা জানি, প্রায়ও সালে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তথা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। তবে এটা সুবিদিত যে, এই সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমল থেকেই। ব্রিটিশরা এদেশে সাম্প্রদায়িকতা বিভিন্ন রূপে আমদানি ও তৈরি করেছিল। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আলফ্রেড লায়াল এর মতে, "ভারতীয় সমাজের চাবিকাঠি হলো ধর্ম। শুধু তাই নয় ব্রিটিশ শাসনের স্বার্থে এগুলোকে অক্ষুন্ন রাধা উচিত। ভারতের চব্বিশ কোটি লোক রক্ত বর্ণ ও ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত। সুতরাং এ বিভক্তি হলো ব্রিটিশ শাসনের স্তম্ভ এবং তা অটুট রাখাই শ্রেয়।" উনিশ শতকের শেষার্ধে ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস ও বিংশ শতকের প্রথমে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের জন্ম। কংগ্রেস ব্রিটিশদের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে গঠিত হলেও পরে তা ভারতীয় স্বাধীনতার ধারকবাহক হয়ে ওঠে। মুসলিম লীগ কংগ্রেসের হিন্দুপ্রীতির বিরুদ্ধে মুসলমানদের স্বার্থের ধারক হয়ে উঠলেও পরে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলনের অগ্রদূত হয়ে উঠে। আবার এর বিপরীতে কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন গড়ে ওঠে। ফলে এদেশীয় সরল রাজনীতি স্বার্থের ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে হয়ে ওঠে জটিল ও কুটিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবের পর পর এদেশে ধর্মীয় ধারার দল দুটির বিরুদ্ধে কিছু বামপন্থি দলের বিকাশ ঘটে। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ দল দুটির প্রভাবে এ ধারা মাথা তুলতে পারেনি। উপরন্ত মুসলিম লীগের এক অধিবেশনে জিন্নাহর সভাপতিত্বে শেরে বাংলা ১৯৪০ সালে ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব তথা পাকিস্তান প্রস্তাব তুলে ধরেন, যা পরবর্তীতে রাজনীতির মাঠের দাবির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এবং ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন প্রণীত হয় এবং সৃষ্টি হয় পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের শুরু ১৯৪৭ সাল থেকে পরবর্তী ২৪ বছরব্যাপী। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু এর পিছনে ঘটে অনেক আন্দোলন এবং ষড়যন্ত্র। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার সময় একটি দাবি ওঠে পূর্ব বাংলাকে ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে না দেখে বরং সংস্কৃতির ভিত্তিতে বিবেচনা করে এক বাংলা গঠনের প্রস্তাবও আসে কংগ্রেস নেতা শরৎ বসু ও মুসলিম লীগ নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী এর যৌথ প্রস্তাবে। কিন্তু বড় দুই দলের মানসিকতার কাছে তাদের তথা সাধারণ জনগণের চাওয়া এ প্রস্তাব ধোপে টেকেনি। প্রাসঙ্গিকভাবেই বিষয়গুলো এ কোর্সের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন: লাহোর প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য কি ছিল ?
৬. বৈষম্য: ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান ভারত সৃষ্টি হলেও পাকিস্তানে জাতি গঠনের অন্যান্য উপাদান যেমন- ভাষা, নরগোষ্ঠী, সংস্কৃতি, জীবনধারা, অঞ্চল ইত্যাদি প্রায় কোনোটির মধ্যেই মিল দেখা যায় না। ফলে এ রাষ্ট্রটি যে খুব বেশিদিন টিকতে পারে না তখনকার কিছু নেতৃত্ব বলেই দিয়েছিলেন। অন্যতম কংগ্রেস নেতা মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পাকিস্তান প্রস্তাব খ্যাত লাহোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, "পাকিস্তান গঠিত হলেও তা বেশিদিন টিকবে না। এর মেয়াদ হতে পারে সর্বোচ্চ ২৫ বছর। কারণ বাঙালি বহিরাগত নেতৃত্ব খুব একটা পছন্দ করে না। ফলে পাকিস্তান হবে আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের ক্রীড়াক্ষেত্র।" যা পরবর্তীতে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। মূলত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই নিহিত ছিল বৈষম্যের বীজ। শাসকরা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি এবং তারা প্রতিক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন উন্নয়ন করার পরিবর্তে। ব্রিটিশদের মতোই তারা এদেশকে নতুন উপনিবেশে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। বলা যেতে পারে বাংলাদেশ সৃষ্টির অন্যতম কারণও এ দমনপীড়নের মাধ্যমে বাঙালিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি এবং শোষণ।
৭. ভাষা আন্দোলন: ভাষা আন্দোলন হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ বাঙালিদেরকে পাকিস্তান থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। যার অনিবার্য পরিণতি হলো স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই গ্রন্থে ভাষা আন্দোলনের ঘটনা, তাৎপর্য সুবিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আমরা জানি, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর নেতৃত্ব মুসলিম লীগের হাতে চলে যায়, কিন্তু তার বেশিরভাগ নেতৃত্ব পশ্চিম পাকিস্তানের এবং তারা বাঙালিকে পুরো পাকিস্তানের নেতৃত্বে কখনোই মেনে নিতে পারেনি। তারই প্রকাশ ১৯৪৮ সালে রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্যের মধ্যেই। বাঙালিকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ধর্মীয় আবরণে তারা সাংস্কৃতিক অগ্রাসন চালাতে চায় প্রথমে ভাষার উপর এবং পরবর্তীতে অন্যান্য ক্ষেত্রে। তাই ঘোষণা করে "Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan." চিরবিদ্রোহী বাঙালি তাই তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার রক্ষার জন্য তাদের বুকের রক্তটুকু দিতে কার্পণ্য করেনি ১৯৫২ সালে। বাঙালিদের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের এহেন আচরণে বিরক্ত তৎকালীন কিছু মুসলিম লীগ নেতা মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ ১৯৪৯ সালে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে। ভাষা আন্দোলনকে বলা হয় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সকল আন্দোলনের জননী হিসেবে। মূলত আওয়ামী মুসলিম লীগের তরুণ নেতৃত্বের হাত ধরেই ভাষার অধিকারটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বাঙালি একইসাথে অনুভব করে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে তাদের অর্জন এমনিতে আসবে না বরং এর জন্য তাদের বারবার ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং তারজন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ প্রেক্ষিতে ১৯৫৪ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গঠিত হয় ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে। যুক্তফ্রন্টের এহেন উত্থানে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রভাব কমে যাওয়ার আতঙ্কে তারা ষড়যন্ত্র শুরু করে। ফলে অনেক ঘাতপ্রতিঘাতের পর যুক্তফ্রন্টের পতন ঘটে কিন্তু আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান জনগণের মধ্যে স্থান করে নেয়। পাকিস্তানে স্বাধীনতার দীর্ঘ ০৯ বছর পর প্রথম সংবিধান প্রণীত হয় এবং একে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। ফলে বাঙালি মানসের পূর্ব পাকিস্তানিদের সাথে এদেশের নেতৃত্বের ও সাধারণ মানুষের আরো দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে।
আরও পড়ুন: বঙ্গভঙ্গ কি ? এর কারণ আলোচনা কর।
৮. পাকিস্তান আমলের সামরিক শাসন: ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাত ১০.৩০ মিনিটে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইসকান্দার মীর্জা সামরিক বাহিনীর সহায়তায় মালিক ফিরোজ খান নুন সরকারকে উৎখাত করে পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেন। তিনি ৭ অক্টোবরের ফরমান বলে পাকিস্তান সেনাপ্রধান জেনারেল মুহাম্মদ আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন। ২৭ অক্টোবর ১৯৫৮ আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট মীর্জাকে উৎখাত করে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেন। ২৮ অক্টোবর আইয়ুব খান এক সরকারি আদেশ জারির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী পদ বিলুপ্ত করেন এবং নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। ক্ষমতা দখলের পর তিনি ঘোষণা করেন রাজনীতিবিদরা দেশ চালাতে অক্ষম হওয়ায় বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীকে আসতে হয়েছে। আইয়ুব খান তার ক্ষমতাকে বৈধ রূপ দিতে চালু করেন 'মৌলিক গণতন্ত্র' যেখানে পছন্দনীয় কাউন্সিলরদের মাধ্যমে ক্ষমতাকে বৈধ রূপ দেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ করা হয়। এ সময় যে কোনো আন্দোলনকে তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অথবা ভারতীয় যড়যন্ত্রের লেবেল এটে তা দমনের জন্য প্রয়োজনে সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে থাকেন। আইয়ুবের নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড বাঙালিকে দমিয়ে রাখার পরিবর্তে আরো বিদ্রোহী করে তোলে। আইয়ুবের ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করে তোলে, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক কর্মীদের এ আন্দোলনে যোগদান এ কার্যক্রমকে বেগবান করে। তারা বুঝতে পারে বাঙালিদের উপর অন্যায় অত্যাচার চালানো ও দমিয়ে রাখার জন্যই এ মামলা। তাই তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলে।
৯. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ: আইয়ুবী আমলে ইসলামের নামে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বাঙালি সংস্কৃতির উপর বিভিন্নভাবে আঘাত হানা হয়। বাংলা বর্ণমালা পরিবর্তন, রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধকরণ, মেলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের উপর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির মাধ্যমে যখন বাঙালি সংস্কৃতির ইসলামীকরণের নামে বাঙালির স্বকীয় সত্তা ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়, তখন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে। বিভিন্ন ধরনের গান, নাটক, মঞ্চনাটক, জীবস্তিকা ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙালিকে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সচেতন করে তোলার অব্যাহত প্রচেষ্টা চলতে থাকে। বাঙালি সংস্কৃতির প্রচারণা ও উজ্জীবন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সামনে নিয়ে আসে। আর রাজনীতি তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র অর্জনের জন্য ইতোমধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ তার নাম পরিবর্তন করে রাখে আওয়ামী লীগ। কাল পরিক্রমায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলার মানুষের প্রাণের দাবি ছয়দফাকে সামনে নিয়ে আসে, যার মধ্যে ছিল অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, দেশরক্ষা অধিকারের রূপরেখা। এর পক্ষে সারাদেশে ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়। ক্রমে এটি বাঙালির প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়। শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন এদেশের রাজনীতির নায়ক। ফলে তার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র শুরু হয়। শুরু হয় স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।
১০. গণ অভ্যুত্থান: দেশকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলন এবং ছয়দফার পর যার স্থান তা হলো ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান যার সাফল্য মাত্র দু'বছরের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রে বড় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। ছয়দফা জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হওয়ায় আগরতলা মামলাকে জনগণ একটি ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখতে থাকে। সর্বস্তরের জনগণ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এর প্রতিবাদ জানায়। বিশেষকরে শেখ মুজিবের হাতে গড়া ছাত্রলীগসহ ছাত্ররা এগারো দফা ঘোষণা করে এবং আন্দোলন জোরদার করতে থাকে। মামলার কার্যক্রম যতই এগুতে থাকে জনদাবি ততই আন্দোলনমুখী হতে থাকে। আশ্চর্যজনকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে এ মামলায় ষড়যন্ত্রের অভিযোগে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করা হয়। এ প্রেক্ষিতে আইয়ুবের ক্ষমতা ত্যাগ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হয়। মুক্ত মুজিবকে নিয়ে জনগণের আনন্দ চলতে থাকে এবং এ সময় ঐতিহাসিক সংবর্ধনা সভায় তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের সহ সভাপতি তোফায়েল আহমেদ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। জনগণ তাদের আন্দোলনের সাফল্যে আনন্দিত হয়ে ওঠে। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করেই সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
আরও পড়ুন: বঙ্গভঙ্গ কি? এর ফলাফল আলোচনা কর।
১১. '৭০ এর সাধারণ নির্বাচন ও অচলাবস্থা: ১৯৭০ সালের নির্বাচনই বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অনিবার্য করে তোলে। কারণ এ নির্বাচনের ফলাফল মেনে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা অর্পণ না করে বাঙালিদের ওপর অমানবিক গণহত্যা শুরু করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুরু হয়েছিল। তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস আলোচনায় একটি অপরিহার্য বিষয় হিসেবে '৭০ সালের নির্বাচন আলোচনা করা হয়েছে। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতনের পর ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে ইয়াহিয়া খান বলেন যে, একটি আইনগত কাঠামো আদেশ জারির মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। তিনি ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ আইনগত কাঠামো আদেশ জারি করেন এবং নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদের নির্বাচন ৭ ডিসেম্বর ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ১৭ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকায় ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনের ফলাফল পশ্চিমাদের বিস্মিত করে। তারা নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে গড়িমসি করতে থাকে। তারা প্রস্তাব দেয় কোয়ালিশন করতে। কিন্তু এদেশের সাধারণ মানুষ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবকে পুরো পাকিস্তানের নেতৃত্বে দেখতে চায়। সামরিক নেতৃত্ব আলোচনার নামে বারবার তাদের কথার বরখেলাপ করে এবং এ সময়টাতে সম্ভাব্য সংঘর্ষের কথা মাথায় রেখে তাদের শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকে এবং বিভিন্ন রকম দমনপীড়ন চালাতে থাকে। ৩ মার্চ যে সংসদের অধিবেশন ডাকা হয় তা হঠাৎ করে স্থগিত করে দেওয়া হয়। ফলে বাধ্য হয়ে ১ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা অকার্যকর হয়ে যায় এবং আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ চলতে থাকে। ২ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ রকম প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রকারান্তরে এদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মানুষ স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে এবং প্রস্তুত হয় বড় একটি যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য। বঙ্গবন্ধু হয়ে যান স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানো এক নায়ক। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে এদেশে আলোচনার নামে আসা ইয়াহিয়া সাধারণ জনগণের আন্দোলনকে কঠোর হাতে দমনের জন্য সেনাবাহিনীকে এদেশের সাধারণ জনগণের উপর লেলিয়ে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। শুরু হয়ে যায় অপারেশন সার্চলাইট এর নামে গণহত্যা, নির্বিচার অত্যাচার ও নির্যাতন। ঐ রাতেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ঐ রাতেই গ্রেফতার হন। কিন্তু আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয়ে যায় বাঙালির চূড়ান্ত মুক্তির লড়াই তথা মুক্তিযুদ্ধ।
১২. গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ: অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে ২৫ মার্চের কালরাতে যে গণহত্যা ও নির্যাতন চালানো হয় তার উদাহরণ ইতিহাসে বিরল। এ আক্রমণ থেকে সর্বস্তরের জনগণের কেউ নিস্তার পায়নি। নির্বিচারে আক্রমণ চালানো হয় পুলিশ, ইপিআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাধারণ পথচারী, দোকানদার, নারী ও শিশুদের ওপর। ঢাকার সাথে একইসময়ে দেশের অন্যান্য অংশে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা শক্তি প্রয়োগ করে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে এদেশীয় কিছু দোসর রাজাকার, আলবদরসহ বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে পাকিস্তানপন্থিরা যোগ দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ ও স্বার্থ হাসিলের উল্লাসে মেতে ওঠে। অপরপক্ষে, সাধারণ জনগণ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যার যা আছে তাই নিয়ে প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে আচমকা আক্রমণে এদেশের জনগণ প্রথমে পলায়নপর হলেও সময়ের প্রেক্ষিতে প্রতিরোধে মানুষ দুর্বার হয়ে উঠে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় কৃষক, শ্রমিক, পুলিশ, ইপিআর, ছাত্র তথা আপামর জনতা। লক্ষ লক্ষ মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যায় এবং কিছুদিনের মধ্যে গেরিলা ট্রেনিংসহ যুদ্ধের জন্য এদেশে প্রবেশ করে। ইতোমধ্যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট করে সরকার গঠিত হয় মেহেরপুরের মুজিবনগরে। সরকার মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেশটাকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে দেয়। এছাড়া তিনজন সেনানায়ক জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ ও শফিউল্লাহর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে ৩টি বিগ্রেড গঠন করা হয়। তাছাড়া আছে আঞ্চলিক প্রতিরোধ কাদেরিয়া বাহিনী, মুজিব বাহিনী ইত্যাদি নামে সাধারণ জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে উদ্দীপনামূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার হতে থাকে, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়। জনপ্রতিরোধ যতই বাড়তে থাকে সেনাবাহিনীর অত্যাচার ততই বাড়তে থাকে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সহায়তায় আন্তর্জাতিকভাবে যেমন শক্তিশালী অবস্থানে আসতে থাকে তেমনি গেরিলা যুদ্ধেও সাফল্য পেতে থাকে। কিন্তু নির্বিচার গণহত্যা থেমে থাকে না বরং তারা 'এদেশের মানুষ চাই না মাটি চাই' এরূপ পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু চিরবিদ্রোহী চরিত্রের এদেশের জনগণ তাতে দমে না গিয়ে পাল্টা আঘাত হানতে থাকে। ভারতের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার হাত ক্রমেই বাড়তে থাকে, মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের হারও বাড়তে থাকে, পাকিস্তানিদের মনোবল ততই কমতে থাকে। ফলে একসময় পাকিস্তান- অসহিষ্ণু হয়ে ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ভারত আক্রমণ করে বসে। তখনই ভারত এ যুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে জড়িয়ে পড়ে মাত্র ১৩ দিনের মাথায় ৯৩ হাজার সুসজ্জিত প্রশিক্ষিত সৈন্যসহ জেনারেল নিয়াজি যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ যুদ্ধে সামগ্রিকভাবে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ শহিদ হয়, নারী নির্যাতিত হয় প্রায় ২ লক্ষ। মাত্র নয় মাসের এ যুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে যে বিজয় সূচিত হয় তাতে বিজয়ের আনন্দে এদেশের আপামর জনতা অংশগ্রহণ করে। কিন্তু এ যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ধ্বংসযজ্ঞ এতই ছিল যে অনেক বড় বড় যুদ্ধের ক্ষতিকেও ছাড়িয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ হয়েছে যুদ্ধাহত ও এতিম।
১৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল ও দেশ পুনর্গঠন: স্বাধীনতার অভ্যুদয়ের ইতিহাস শুধু বিজয়ের একটি লিখিত চুক্তির মাধ্যমেই শেষ হয়ে যায় না। বরং তাকে জানার জন্য আরো কিছুকাল অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দেশে ফিরেন। এ সফরের মাধ্যমে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতির ভিত্তি তৈরি করেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনাসহ দ্বিপাক্ষিক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন। দেশে ফিরেই তিনি সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেন এবং মাত্র এক বছরেরও কম সময়ে মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়ন করেন। দেশকে পুনর্গঠনে তিনি সংবিধানে সমাজতন্ত্রের সংযোজন করেন এবং পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া শিল্পকারখানাগুলোকে জাতীয়করণ করেন। জনগণের উন্নতির জন্য তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা আনার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা করেন এবং একইসাথে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিসহ কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের উদ্যোগ নেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে তিনি কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ, আইএমএফসহ বিভিন্ন ফোরামের সদস্য হন এবং বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায় করতে সমর্থ হন। তিনি এ সময়টাতে যুদ্ধবিধান্ত দেশ পুনর্গঠনে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেন। অবকাঠামো খাতে বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত সেতু, কালভার্ট মেরামতসহ সার্বিক উন্নয়নে কাজ শুরু করেন। কিন্তু এ সময়টাতে কিছু স্বার্থান্বেষী চক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ক্ষমতা দখল করার পর সংবিধান সংশোধন করে এ চক্রটি আবার দেশকে ধর্মান্ধতার সে যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে। এ সময়টাতে কয়েকটি ক্যু ও পালটা ক্যু সংঘটিত হয়। ফলে দেশ আবার অস্থিরতার মধ্যে পড়ে। যেখানে মূলত দ্বন্দ্ব ছিল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সাথে তার বিরোধী আদর্শের।
এভাবে দেখা যায় বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি পেতে এদেশের সাধারণ মানুষকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। ৩০ লাখ তাজা প্রাণ ও ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এ দেশ অর্জিত হয়েছিল। আজ বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ এবং বাঙালি একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে পরিচিত। এদেশের সঠিক ইতিহাস জানা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস গ্রন্থে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url