স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পরিচিতি
ইতিহাসের ভিত্তি হতে পারে কোন জাতি, কোনো সময়কাল, কোনো ভূখণ্ড বা কোনো অঞ্চল বা অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস হলো ১৯৪৭ সাল পরবর্তী তৎকালীন পাকিস্তানের অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাস। সুদীর্ঘ ২৪ বছর এই অঞ্চলের মানুষ পাকিস্তানিদের শাসন শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে। মূলত পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক টাইপের শাসনই বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অনিবার্য করে তোলে। একথা সুবিদিত যে, ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হয়। বর্তমান বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের দূরত্ব ছিল প্রায় ১২০০ মাইল। ব্যাপক দূরত্বের দুটি ভূখণ্ডের জনগণের মধ্যে ধর্মীয় মিল ছাড়া আর কোনো মিল ছিল না। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান স্বাধীন হলেও এর নেতৃত্ব ছিল মূলত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বুর্জোয়া ও পরবর্তীতে সামরিক বাহিনীর হাতে। আইয়ুব, ভুট্টো, ইয়াহিয়াদের নেতৃত্বের অহমিকাবোধ সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানিদেরকে তাদের নায্য অধিকার পেতে বার বার বাধা দিয়ে এসেছে। রাজনীতির দাবাখেলায় বার বার পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ হয়েছে নিষ্পেষিত ও পরাজিত। কিন্তু চিরবিদ্রোহী বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম প্রচেষ্টা তাতে থেমে যায়নি। যদিও তা হয়েছে প্রলম্বিত কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তা হয়েছে জোরদার যার ফলস্বরূপ স্বাধীনতা। মূলত এ বিদ্রোহের প্রেরণাটি এসেছে সে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে সাফল্যের প্রেরণা থেকেই। বাংলার জনগণ যে বিদ্রোহী চরিত্রের তা বিভিন্ন ঐতিহাসিকের বর্ণনা থেকেও পাওয়া যায়। মুঘল আমলের ঐতিহাসিক ইবনে বতুতা সুবে বাংলাকে 'নিয়ামতপূর্ণ দোজখ' নামে অভিহিত করেছিলেন। তাই বাংলার জনগণকে দমিয়ে রাখার কোনো প্রচেষ্টাই শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বঞ্চনা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে জনগণকে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হওয়া সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানিদের হাতে থাকার কথা তার পরিবর্তে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলার জনগণকে বাঁকা চোখে দেখতে থাকে। সমস্ত শাসনতান্ত্রিক আয়োজন পশ্চিম পাকিস্তানকে ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে। ভারত বিভক্ত হওয়ার পর পূর্ববাংলা সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হওয়ার পরেও পাকিস্তানের রাজধানী করা হয় করাচি, পরবর্তীতে ইসলামাবাদকে। যেখানে তৎকালীন করাচিকে রাজধানীতে উন্নীতকরণে ব্যয় ধরা হয় ২০০ কোটি টাকা, ইসলামাবাদকে উন্নীতকরণে ব্যয় ধরা হয় ২০ কোটি টাকা; সেখানে ঢাকা উন্নীতকরণে ব্যয় ধরা হয় মাত্র ২ কোটি টাকা। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে ভাসানী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে তখন পাকিস্তানি নেতৃত্ব বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। মাত্র দু'মাসের মাথায় ফজলুল হক সরকারকে বরখাস্ত করে গভর্নরের শাসন জারি করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ৪ বছরের মধ্যে ৭টি সরকার পরিবর্তন ও তিনবার গভর্নরের শাসন জারি করা হয়। এক্ষেত্রে পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বারবার নাকগলানো এতদাঞ্চলের জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। এরপর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় ৯ (১৯৪৭-৫৬) বছর পর পাকিস্তানের সংবিধান প্রণীত হলেও তা মাত্র ২ বছরের বেশি টিকতে পারেনি। সেনাপ্রধান আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে সংবিধান স্থগিত করেন এবং নিজের মতো করে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। তিনি গণতন্ত্রের এক নতুন রীতি মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেন, যেখানে সাধারণ জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। পরবর্তীতে তিনি গণআন্দোলনের মুখে ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ১৯৬৯ সালে পদত্যাগ করেন। ইয়াহিয়া খান এসে নির্বাচনের নামে ২ বছর নিজ ইচ্ছামতো শাসন পরিচালনা করেন এবং একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশের উপর এক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেন। মূলত ২৪ বছরের (১৯৪৭-৭১) পাকিস্তান আমল মাত্র ২ বছর সংবিধানের আলোকে পরিচালিত হয় আর বাকি সময়টিই পাকিস্তানি নেতাদের ও তাদের দোসর সামরিকবাহিনীর হাতে ইচ্ছামতো দেশ পরিচালিত হয়; যেখানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের জনগণকে তথা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কোনো স্বাধীন বা আইনগতভাবে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।
আরো পড়ুন: লাহোর প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কি ছিল ?
অর্থনৈতিক দিক থেকেও এদেশের জনগণ ছিল বঞ্চিত ও শোষিতের দলে। তৎকালীন পরিসংখ্যান অনুযায়ী সমগ্র পাকিস্তানের ৪৩.৭ ভাগ মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানে আর ৫৬.৩ ভাগ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে বাস করত। জনসংখ্যায় অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ের মাত্র ২৫-৩০% এ অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ ছিল; যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের উৎপন্ন দ্রব্য রপ্তানি করে ৬০-৬৫% বৈদেশিক আয় হতো। কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব আয়ের ৬০% অর্জিত হতো এদেশ থেকে অথচ এর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি দ্রব্য ছিল পাট, চা ও চামড়াসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কৃষিপণ্য। নতুন করে এতদাঞ্চলে কোনো শিল্প কলকারখানা গড়ে তোলা হয়নি। বরং এদেশের কাঁচামাল পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে শিল্পজাত পণ্যে রূপান্তর করা হতো। এমনকি এদেশে যেসব ছোটো কারখানা ছিল তার ৪৩% এর মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির ক্ষেত্রেও তিন- চতুর্থাংশ তাদের দখলে ছিল। দেশরক্ষার সদর দপ্তর, স্টেট ব্যাংকের প্রধান ভবন, আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, বৈদেশিক দূতাবাসসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক কার্যক্রমের প্রধান এলাকা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে।
আরো পড়ুন: লাহোর প্রস্তাবের মূলধারা সমূহ উল্লেখ কর?
পাকিস্তান আমলে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এদেশকে যথেষ্ট অবহেলা করা হয়। ভাষাকে কেন্দ্র করে সর্বপ্রথম পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সংঘাত ঘটে। এতদঞ্চলের মানুষ ছিল অসাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তিসম্পন্ন। ধর্মের পার্থক্য মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহযোগিতার বন্ধনকে শিথিল করতে পারেনি। আবহমানকাল থেকে বাংলা অঞ্চলে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির বন্ধন বজায় ছিল। তাই দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও এদেশের জনগণ মুসলিম হওয়ার পরিবর্তে বাঙালি হওয়ার দিকে মনোযোগী ছিল বেশি এবং তা রক্ষায়ও তারা ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এদেশের জনগণের প্রধান পেশা ছিল কৃষি। কৃষিকে ঘিরে এখানকার অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি পরিচালিত হয়। ফসলের মৌসুমে মানুষ একে অন্যকে সাহায্য সহযোগিতা করত, সেখানে হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ ছিল না। অবসরের সময়গুলোতে হিন্দু মুসলিম একসাথে আনন্দ আয়োজনে শামিল হতো। মেলা, পার্বণ, পুঁথিপাঠ, নাচগান, যাত্রাপালা একসাথে করেই সময় পার করতো। সামাজিক ক্ষেত্রে এদেশের মানুষ ছিল অপেক্ষাকৃত আমোদপ্রিয়। ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের পরিবর্তে তারা সঙ্গী-সাথি অথবা আত্মীয়স্বজনের সাথে মিলেমিশে তা ব্যয় করতো। স্বজনের প্রয়োজনে শেষ সম্বলটুকু পর্যন্ত তারা ব্যয় করতে কার্পণ্য করতো না। বেশিরভাগ পরিবার ছিল যৌথ প্রকৃতির। সেখানে পরিবারের প্রধান বাবা, দাদার নির্দেশই ছিল সব। কারো সাধ্য ছিল না সে নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার। এহেন অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের বাঙালিকে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক করার পথে দ্বিজাতিতত্ত্ব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
আরো পড়ুন: লাহোর প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য কি ছিল ?
অস্বাভাবিক দূরত্বের দুটি অঞ্চলের দুটি ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হলেও কেবল ধর্মীয় মিল ছাড়া উভয়ের মধ্যে কোনো মিল দেখা যায় না। এ দুই অংশের আর্থসামাজিক কাঠামোতে ছিল ভারসাম্যের অভাব। পাকিস্তানের মোট ভূখণ্ডের ৮৪.৩ ভাগ আয়তন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের এবং মাত্র ১৫.৭ ভাগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের, অথচ মোট জনসংখ্যার ৪৩.৭ শতাংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে এবং ৫৬.৩ ভাগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চবিত্তের অস্তিত্ব ছিল না। ব্রিটিশ আমলে পূর্ববাংলার উচ্চবিত্তরা ছিলেন জমিদারগোষ্ঠী যাদের বাস ছিল কলকাতায়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় তারা ভারতে চলে যায় এবং তাদের সম্পত্তি ভারতে স্থানান্তর করে। উপরন্তু ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করা হলে এখানকার মুসলমান জমিদারদের পতন ঘটে। এরকম পরিস্থিতিতে এদেশের রাজনীতি ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের দখলে। অপরদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থা বর্তমান থাকায় তাদের হাতেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বেশি সম্পত্তি থেকে যায়। তাই উন্নত শহর,, অবকাঠামো এবং শিল্পকারখানা ঐ দেশেই গড়ে ওঠে। পক্ষান্তরে, উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু শিল্পকারখানা এদেশে গড়ে উঠলেও তা ছিল মূলত চিনি ও পাটকল এবং তা ছিল প্রায় কলকাতার আশপাশে।
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url