১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কারণসমূহ
আসলামু আলাইকুম, প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কারণ কারণ গুলো স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস বিষয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যা প্রায় সময়েই পরীক্ষায় আশে। তাই এই ব্লগে তোমাদের সাথে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কারণ কারণসমূহ আলোচনা করা হল।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কারণ
উত্তর: ভূমিকা। ১৯৪৭ সালের ৮ আগষ্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাঙালির অস্তিত্বকে অস্বীকার করে আসছে। একই সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ ও বৃদ্ধি পেতে থাকে যার প্রকাশ ঘটে. সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সরকারি কর্মকান্ডে। পাকিস্তান জন্মের পর পরই পাক শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে এবং মাতৃভাষার অধিকারহরণের চেষ্টা করে। এর প্রেক্ষিতে ১৯৫২ সালে পূর্ববাংলায় ভাষারদাবিতে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে উঠে। অবশেষে পাক শাসক গোষ্ঠী বাঙালির মাতৃভাষার দাবি মানতে বাধ্যহয় এর রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করে। ভাষা আন্দোলনের কারণসমূহঃ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায় এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই ভাধা আন্দোলনের মূল কারণ। এর পাশাপামি সাংস্কৃতিক স্বার্থ ও রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক অধিকারের প্রশ্ন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছে। ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হবার কারণ হিসেবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো চিহ্নিত।
১. ভাষা সংস্কৃতির ওপর আঘাতঃ বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে চক্রান্তের অংশ হিসেবে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সর্বপ্রথম বাঙালির সংস্কৃতি তথা ভাষার উপর আঘাত হানে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫৬ ভাগ লোকের মাতৃভাষা সত্ত্বে পাক। শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়াস চালায়। বাংলা ভাষার ওপর আঘাতের প্রতিক্রিয়াও ছিল বেশ জোড়ালো। ভাষার দাবিতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠে এবং সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা অঙ্গন থেকে দুর্বার গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে।
২. ধীরেন্দ্রনাথের প্রস্তাবের বিরোধিতাঃ ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন আন্ত হয়। এ অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সাথে বাংলাকের গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। মুসলিম লীগ সদস্যগণ এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা ছ করেন এমনকি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও এ প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করেন। এখবর ঢাকায় পৌছালে হার সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
আরও পড়ুন: ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর।
৩. বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা ও সর্বত্র উর্দুর ব্যবহারঃ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু হয়। মানি অর্ডার কম, ডাকটিকেট, এবং মুদ্রার শুধুমাত্র ইংরেজি ও উর্দুর ব্যবহার এবং এগুলিতে বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করা হয়। এর প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার জনসাধারণ ও শিক্ষিত মহলে যথেষ্ট উদ্বেগ ও বিরুদ্ধ মনোভাবের সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ আন্দোলনের মধ্যে তার প্রতিফলন ঘটে।
৪. মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের ঘোষণাঃ পাকিস্তানের স্বাধীনতার অব্যহতি পর থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী তথা মুসলিন লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে উর্দুর পক্ষে ঘোষণা দিয়ে আসছিলেন। ১৯৪৮ সালে ২১ মার্চ পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ঘোষণাকরেন State language must be urdu, shall bc urdu. এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালে ঢাকা সফরে এসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও জিন্নাহর কথার পুনরাবৃত্তি করেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে এমন বৈষম্য মূলক ঘোষণা আসায় পূর্ব বাংলার জনসাধারণ ও ছাত্র সমাজ তীব্র অসন্তুষ্ট হয় এবং ভাষার দাবিতে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে।
৫. কলিকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকা নিষিদ্ধকরণঃ বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্তের আর একটি কৌশল ছিল বাংলা পত্রিকা নিষিদ্ধকরণ। ১৯৪৮ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান সরকার "রাষ্ট্রবিরোধী" প্রচারনার অভিযোগে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকাগুলো পূর্ব বাংলায় নিষিদ্ধ করা হয়। পত্রিকাগুলোর মধ্যে অমৃতবাজার পত্রিকা, আনন্দ বাজার পত্রিকা, দৈনিক স্বাধীনতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ফলে জনমনে তীব্র অসন্তোষ দানা বাঁধে যা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে।
৬. বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তণের ষড়যন্ত্রঃ ১৯৪৭ সাল থেকেই আরবি হরফে বাংলা লেখার একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র শুরু হয়। যা ১৯৪৯ সাল থেকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়, অর্থাৎ বাংলা ভাষা লেখা হবে আরবি হরফে। পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব ফজলুর রহমানের এমন যোষণার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলা থেকে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলে।
৭. বাংলা ভাষা ভাষীদের প্রতি অভহেলিত বৈষম্যমূলক আচরণঃ পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা বাংলা ভাষাভাষী তথা বাঙালিদের হেয় প্রতিপন্ন করত। তারা বাঙালি মুসলমানদের নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান বলে গণ্য করত। বাংলা ভাষাকে তারা হিন্দুদের ভাষা মনে করত করত উত্তর ভারত থেকে আগত মোহাজেররা উর্দু ভাষাভাষী ছিল এবং তারা উর্দুকেই মুসলমানের ভাষা মনে করত। পাকিস্তানীদের সঙ্গে বাঙালিদের সামাজিক বৈষম্য ভাষার উপর প্রভাব পড়ে যা ভাষা আন্দোলনের কারণ হিসেবে কাজ করে।
৮. অর্থনৈতিক কারণঃ ভাষা আন্দোলনের মূলে অর্থনৈতিক কারণ ও বিদ্যমান ছিল। পাকিস্তানের অর্থনীতির বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করত উত্তর ভারত থেকে আগত উর্দু ভাষাভাষী মোহাজেররা। তাঁরা নতুন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার, ব্যবসা বাণিজ্য, ব্যাংক ইত্যাদি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করত। উর্দু ভাষাভাষীদের অর্থনৈতিক প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য পাকশাসকগোষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়াস চালায়। অপরদিকে উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলা ভাষা ভাষীদের তথা বাঙালিদের প্রশাসনিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা ইত্যাদি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ সঙ্কুচিত হবে। এ আশঙ্কা থেকে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি অর্থনৈতিক অধিকারের প্রশ্নকে সামনে রেখে ভাষার দাবিতে আন্দোলনে ঝেপে পড়ে।
৯. রাজনৈতিক কারণঃ ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও কালক্রমে তা রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে এবং অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, দল, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষক, ছাত্র সংগঠন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানের রাজধানীতে উর্দু ভাষাভাষী মোহাজেরসের প্রাধান্য লক্ষণীয়। লিয়াকত আলীর মন্ত্রিসভাকে মোহাজাহের মন্ত্রিসভা বলা হত। রাজনৈতিক প্রধান্য বজায় রাখার জন্য পাক শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা চালায় অন্যদিকে পূর্ব বাংলায় এর বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন নামে তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠে।
১০. বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশঃ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫৬ ভাগ লোকের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর হতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একটি বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে। যারা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীরভাবে অণুরক্ত ছিল। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে থেকে বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসলে তা বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থে আঘাত হানে। ফলে এর প্রতিবাদে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলে।
১১. মূলনীতি কমিটির রিপোর্টঃ ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ গণপরিষদের ভবিষ্যৎ সংবিধানের মৌলিক বিষয় সম্বন্ধে রিপোর্ট তৈরীর উদ্দেশ্যে একটি মূলনীতি কমিটি গঠিত হয়। ১৯৫০ সালে মূলনীতি কমিটির অন্তবর্তীকালীন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে জনগণের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের দাবিসহ বাংলা ভাষার দাবি মানা হয়নি। বরং তাতে নগ্নভাবে বলা হয়েছিল যে- উর্দ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। রিপোর্ট প্রকাশিত হলে তা পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ ও জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, উল্লেখিত কারণগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মূলে নিহিত। বাঙালির মাতৃভাষা "বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা" হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই ভাষা আন্দোলনের মূল কারণ। ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও কালক্রমে তা রাজনৈতিক চরিত্র ধারণ করে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে সরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করেই ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url