অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ব্যর্থতার কারণ

অখণ্ড স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে সোহরাওয়ার্দীর সাথে আবুল হাশিম 'স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পাকিস্তান আন্দোলনের উন্মত্ততা, বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃত্বের মধ্যকার বিরোধ, সাংগঠনিক দুর্বলতাসহ বিভিন্ন কারণে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।

অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ব্যর্থতার কারণ

নিম্নে অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. সাংগঠনিক দুর্বলতা: যে কোনো আন্দোলন সংগ্রামের সফলতার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও সংগঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নেতৃত্বের ক্যারিশমা এবং সংগঠনের দক্ষতার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত হয়। স্বাধীন অখণ্ড বাংলা আন্দোলনে এ দুটিরই তীব্র অভাব ছিল। বিশেষ করে এ প্রস্তাবের সংগঠকগণ বাংলার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গকে একই সামন্তরালে এনে প্রস্তাব গ্রহণে বাধ্য করতে না পারায় স্বাধীন বাংলা আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ব্যর্থতার কারণ

২. কংগ্রেসের হাইকমান্ডের বিরোধিতা: কংগ্রেসের হাইকমান্ড কখনোই অখণ্ড বাংলাকে সমর্থন করেনি। অখণ্ড স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনাকে 'একটি ফাঁদ' হিসেবে আখ্যায়িত করে প্যাটেল বাংলার প্রভাবশালী হিন্দু ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে এ ফাঁদে পা না দেওয়ার জন্য সতর্ক করে দেন। অধিকন্তু কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে শেষ পর্যন্ত ভারত বিভাগকে এ শর্তে মেনে নিতে চেয়েছিল যে, বাংলা ও পাঞ্জাব হিন্দু-মুসলমান অধিবাসী এলাকা হিসেবে ভাগ করতে হবে। এমনকি মহাত্মা গান্ধি অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিটি কৌশলে এড়িয়ে যান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলির বক্তব্যে ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে খুব শীঘ্রই ইংরেজদের ভারত ত্যাগের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ অবস্থায় দেরি না করে কট্টর হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠন 'হিন্দু মহাসভা' ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নেতৃত্বে বাংলাকে বিভক্ত করে কলকাতাসহ হিন্দু প্রধান এলাকা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ গঠন এবং এ নতুন প্রদেশকে ভারত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তকরণের আন্দোলন শুরু করে।


আরো পড়ুন: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস


৩. মুসলিম লীগ হাইকমান্ডের কৌশলগত নিষ্ক্রিয়তা: বাংলাকে অখণ্ড রাখার প্রশ্নে এ সময় মুসলিম লীগের হাইকমান্ড পক্ষেও না, আবার বিপক্ষেও না এরকম অবস্থান গ্রহণ করে এবং এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা অবলম্বন করে। মুসলিম লীগের কর্ণধার জিন্নাহর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান নামক একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। অখণ্ড বাংলার আন্দোলন চলাকালে জিন্নাহ বিভিন্ন কারণে বাংলাকে স্বাধীন মর্যাদাদানে সম্মত থাকলেও প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে তিনি তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করেননি, বরং সোহরাওয়ার্দী- হাশিম যখন অন্য সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের সাথে সমঝোতার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন জিন্নাহর অনুগত খাজা গ্রুপ এমন ধারণা লাভ করেছিল যে, হিন্দু নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য লীগের হাইকমান্ড কাউকে ক্ষমতা দেয়নি। এভাবে জিন্নাহ বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের উভয় গ্রুপকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেন।


৪. প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব: বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের কাছে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনাটি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে প্রণীত এবং 'পাকিস্তান' ধারণার সাথে সংগতিপূর্ণ। তারা চেয়েছিল পাকিস্তান পরিকল্পনার প্রতি বাংলার হিন্দুদের বিরোধিতা দূর করে এর মাধ্যমে স্বাধীন পূর্ববঙ্গকে আর্থিক ও সামরিক দিক দিয়ে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করা। এ গ্রুপ আরো মনে করে, অর্থনৈতিক ঐক্য, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং একটি কার্যকর শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের আবশ্যকতা বিবেচনায় বাংলা সর্বদাই অবিভাজ্য। কিন্তু প্রাদেশিক মুসলিম লীগের খাজা গ্রুপ মনে করে যে, পাকিস্তানের সাথে বন্ধনহীন অবস্থায় বাংলার মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হিন্দুস্থানের শক্তি মোকাবিলা করতে সমর্থ হবে না এবং কালক্রমে বাংলা ভারতের একটি অংশে পরিণত হবে। তাই এ গ্রুপটি চেয়েছিল, বাংলা বিভক্ত হোক বা না হোক, পাকিস্তানের একটি অংশেই পরিণত হোক।


আরো পড়ুন: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পরিচিতি


৫. পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের গুরুত্ব: কলকাতা শহরকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের সম্পদ, সমৃদ্ধি ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে কংগ্রেসের হাইকমান্ড ও হিন্দু সম্প্রদায় এগুলোর ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপনে তৎপর ছিল। কলকাতাসহ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ বাংলার অর্ধাংশ পেলে বাংলার বিভক্তিতে পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের কোনো ক্ষতি ছিল না। জিন্নাহ নিজেও মনে করতেন, কলকাতা ছাড়া বাংলার কোনো মূল্য নেই। অন্যদিকে, আসাম পেট্রোল ও অন্যান্য খনিজ সম্পদে ভরপুর ছিল। কৌশলগত দিক থেকেও আসাম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু বাংলা অখণ্ড থাকলে তা আসামকে ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এসব কারণেও কংগ্রেস ও হিন্দু নেতৃবৃন্দের সিংহভাগই বাংলা ভাগের পক্ষে সোচ্চার ছিল।


৬. জনসংখ্যার বিভাজন: বাংলার জনসংখ্যার বিভাজন স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলায় হিন্দু মুসলমান জনবসতি এমনভাবে গড়ে উঠেছিল যে, পূর্ব বাংলায় মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পশ্চিম বাংলায় হিন্দুরা। ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ ক্রিয়াশীল ছিল। তাছাড়া পশ্চিম বাংলা শিল্প কলকারখানায় এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ থাকায় বাংলা ভাগ হলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল না। উপরন্তু তারা মনে করেছিল পশ্চিম বাংলা ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত হলে হিন্দুরাই সারাজীবন সরকার গঠন করতে পারবে। তাই তারা অভিন্ন বাংলার অধীনে ক্ষমতা ভাগাভাগির চেয়ে একক শাসন ক্ষমতা লাভের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দেয়। ফলে হিন্দু নেতৃবৃন্দ অখণ্ড বাংলা আন্দোলনে এগিয়ে আসেনি।


৭. সময়ের সীমাবদ্ধতা: অনেকের মতে, অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব এসেছে অনেক দেরিতে। তাই এটা ফলপ্রসূ হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের ২৬ এপ্রিল ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের সাথে সাক্ষাৎ করে সোহরাওয়ার্দী জানান যে, "পর্যাপ্ত সময় পেলে তিনি বাংলার অখণ্ডতা বজায় রাখতে সক্ষম হবেন এবং এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত।" এ সময় ভাইসরয় তাঁকে জানান যে, বাংলাকে অবিভক্ত ও স্বাধীন রাখার সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে তিনি সর্বোচ্চ দু'মাস সময় পেতে পারেন। কংগ্রেস ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরোধিতা বাদ দিলেও নিজ দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব যেখানে প্রকট, ঐকমত্যে আসার ক্ষেত্রটি যেখানে সংকুচিত, সেখানে মাত্র দু'মাসে একটি নতুন স্বাধীন ও অখণ্ড রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সত্যই দুরূহ ব্যাপার ছিল।


৮. ব্যক্তিত্বের সংঘাত ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব: ঐ সময় এ. কে. ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম ছিলেন জনপ্রিয় বাঙালি নেতা। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, অবাঙালি মুসলিম নেতারা বাংলার মুসলমানদের বিশেষ কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না এবং কর্তৃত্ব চলে যাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। তাই তাঁদের আগ্রহ ছিল বাঙালি জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রতি। কিন্তু তাঁদের এ পরিকল্পনাকে যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তারা দূরদর্শিতা ও সমন্বয় করার দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। এ ব্যর্থতায় বিভিন্ন কারণ থাকলেও তাঁদের মধ্যকার ব্যক্তিত্বের সংঘাত ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রবল থাকায় এ পর্যায়ে তাঁরা সফলকাম হতে পারেননি। মুসলিম লীগের হাইকমান্ড বা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বাঙালি নেতাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতময় সম্পর্ককে তাঁদের পরিকল্পিত একক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে কাজে লাগিয়েছিল।


৯. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা: ভারত বিভক্তির শেষ দিকে সমগ্র ভারতে হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে কলকাতায় হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এর অব্যবহিত পরে নোয়াখালীতেও অনুরূপ জঘন্য দাঙ্গা হিন্দু মুসলিম সম্পর্কে ব্যাপক ফাটল সৃষ্টি করে। এ সময় হিন্দু মালিকানাধীন সংবাদপত্রসমূহ সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে হিন্দু মুসলমানদের আরো বেশি শঙ্কিত করে তোলে। এমতাবস্থায় অখণ্ড বাংলা আন্দোলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


আরো পড়ুন: লাহোর প্রস্তাবের মূলধারা সমূহ উল্লেখ কর


১০. নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাব: বসু-সোহরাওয়ার্দীর দূরদর্শিতা, দৃঢ় মনোবল ও উদার মনোভাবের অভাব বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। বাঙালি শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রবল থাকায় তারা এক কাতারে এসে অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। এ সুযোগে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব অখণ্ড বাংলার বিরোধিতা করে। ফলে বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ হয়।


সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বহুবিধ কারণে দেশবিভাগের প্রাক্কালে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। বাংলার তৎকালীন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে দুই সম্প্রদায়ের পরস্পরবিরোধী স্বার্থ বিবেচনায় একটি বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে ওঠা কঠিন ব্যাপার ছিল। তবে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় যদি ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবের প্রতি অবিচল থেকে স্ব স্ব হাইকমান্ড থেকে অনুমোদন নিতে পারত তাহলে এ উদ্যোগ অবশ্যই সফল হতো বলা যায়। তখন বাংলার চিত্র অন্য রকম হয়ে উঠত। সোহরাওয়ার্দীর মতে, হিন্দু ও মুসলমানরা সম্মিলিতভাবে বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারলে এটা একটি মহান দেশে পরিণত হতো, ভারতীয় উপমহাদেশে যা হতো সবচেয়ে সমৃদ্ধ।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url