১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস | The Creation of Pakistan, 1947

পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস, ১৯৪৭


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে উপনিবেশসমূহে যখন স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয় তখন ভারতীয় উপমহাদেশও এর বাইরে যেতে পারেনি। এসময় ভারত বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের সৃষ্টি ছিল উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভারতবর্ষে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক মতানৈক্য, সাম্প্রদায়িক সংঘাত, শাসনতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলা যখন চরম আকার ধারণ করে তখন নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক ঘোষণায় ভারত বিভক্তি ও এক ধরনের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দেন। তাঁর এ ঘোষণাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতের ভাইসরয় নিযুক্ত হয়ে ভারত বিভাগের উদ্দেশ্যে ৩ জুন একটি পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকারের নিকট অনুমোদনের জন্য পেশ করেন, যা 'মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা' নামে সুপরিচিত। এ পরিকল্পনার সুপারিশসমূহের ওপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা আইন পাস হয়। এ আইন অনুসারে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার মধ্য দিয়ে ভারত বিভক্ত হয়।


আরো পড়ুন : প্রাচীন বাংলার জনপদ সমূহ ?


The Creation of Pakistan, 1947


পাকিস্তান সৃষ্টির প্রেক্ষাপট Background of Emergence of Pakistan State


১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশি যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে বাংলার মুসলমানরা তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বই হারায়নি, বরং এটা ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের পর ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত ঘটায়। এর পর থেকে ব্রিটিশদের কুশাসন, মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের অবজ্ঞার বিরুদ্ধে চলতে থাকে আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় আসে ১৮৫৭ সালের সিপাহিবিদ্রোহ, যা ভারতের ইতিহাসে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত। এ আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও তা ভবিষ্যতের আজাদি আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। এ সময় একদিকে মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের দমন ও নির্যাতন নীতির কারণে যখন নিষ্পেসিত ও দিশেহারা অবস্থায় পতিত, অন্যদিকে তখন হিন্দু সম্প্রদায় নতুন প্রভুদের সাথে সহযোগিতা করে তাদের সহানুভূতি নিয়ে শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি প্রভৃতিতে ক্রমান্বয়ে উন্নতি লাভ করতে থাকে। ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে আবির্ভাব ঘটে মুসলিম জাতির অগ্রদূত হিসেবে স্যার সৈয়দ আহমদের। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তৎকালীন পরিস্থিতিতে ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা ছাড়া মুসলিম জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। এজন্য তিনি পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায়কে সচেতন করে তোলার পাশাপাশি পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের সাথে তাদের পরিচিতি ঘটানোর এক আন্দোলন গড়ে তোলেন, যা ইতিহাসে 'আলীগড় আন্দোলন' নামে খ্যাত।


আরো পড়ুন : লাহোর প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কি ছিল ?


এ আন্দোলনের ফলে মুসলমানগণ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পৃথক জাতি হিসেবে আন্দোলনের এক নতুন পথের সন্ধানপ্রাপ্ত হয়। ফলে ১৮৮৫ সালে ভারতে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হিন্দু নেতৃবৃন্দ সমগ্র ভারতবর্ষে একটি মাত্র হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তৎপরতা চালালে স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলমানদের এ সংগঠনে যোগ দিতে বারণ করেন। তদুপরি যুক্তপ্রদেশে উর্দু ও হিন্দি ভাষা নিয়ে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরোধ, বালগঙ্গাধর তিলক কর্তৃক গোরক্ষা সমিতি গঠন এবং কংগ্রেসের বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫) বিরোধিতা প্রভৃতি মুসলমানদের জন্য একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা তীব্র করে তোলে। এ প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ সরকার ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে মুসলমানদের সকল প্রকার রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ১৯০৬ সালে গঠিত হয় মুসলিম লীগ। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ফলেই ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে দুই জাতি তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয়, যার অনিবার্য পরিণাম হলো ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা লাভ।


বঙ্গভঙ্গের কারণে ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান ও প্রতিহিংসার কারণে যে অরাজকতা দেখা দেয় তা প্রশমনের জন্য তদানীন্তন ভারত সচিব লর্ড মর্লি এবং ভাইসরয় লর্ড মিন্টো ১৯০৯ সালে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারে এক দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা মর্লি-মিন্টো সংস্কার নামে সুপরিচিত। এ সময়ে ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ভারতে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী প্রথা চালু করা হয়। এ আইন যখন বিবেচনাধীন ছিল, তখন মুসলমান জাতি তাদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি উত্থাপন করে এবং আইন পরিষদে অধিকসংখ্যক আসন দাবি করে। মূলত বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে তাদের ব্যাপক হতাশা এবং সংকীর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতি ঘৃণা থেকে মুসলমানরা এ দাবি উত্থাপন করে। কিন্তু পরবর্তীকালে বঙ্গভঙ্গ রদ, কানপুরের মুসলিম জনতার ওপর নৃশংসতা এবং বলকান যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে মুসলমানগণ ব্রিটিশ সরকারের অঙ্গীকারের অসারতা অনুধাবন করতে পেরে তারা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এ উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উদ্যোগে ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস লক্ষ্ণৌতে এক যৌথ অধিবেশনে বসে শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনাসংবলিত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ লক্ষ্ণৌ চুক্তির মাধ্যমে কংগ্রেস মুসলমানদের একটি পৃথক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ যৌথভাবে ব্রিটিশ সরকারের নিকট স্বায়ত্তশাসনের দাবি পেশ করে।


আরো পড়ুন : লাহোর প্রস্তাবের মূলধারা সমূহ উল্লেখ কর


১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটেনকে সাহায্য করে এই শর্তে যে, তুর্কি খিলাফতের কোনো ক্ষতি হবে না এবং যুদ্ধ শেষে ভারতবাসীকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ সরকার তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে ১৯২০ সালে এর প্রতিবাদে মওলানা শওকত আলী, মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখের নেতৃত্বে তুরস্কে বিদ্যমান খিলাফতের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য খিলাফত আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে এবং মুসলিম সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯২৯ সালের জানুয়ারিতে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর বিখ্যাত চৌদ্দ দফা উত্থাপন করেন। এ চৌদ্দ দফায় মুসলমানদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অধিকার সংরক্ষণের সুস্পষ্ট দাবি ছিল। কংগ্রেস বা হিন্দু সম্প্রদায় দাবিগুলোর প্রতি অনীহা দেখালে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও দার্শনিকগণ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকল্পে চিন্তা করতে থাকেন। এভাবে ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের এলাহাবাদ সম্মেলনে মহাকবি আল্লামা ইকবাল ভারতীয় মুসলমানদের রাজনীতি, জীবনদর্শন ও তমদ্দুনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও কাশ্মীর নিয়ে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করেন। এর পর ১৯৩২ সালে চৌধুরী রহমত আলী পাঞ্জাবের P, আফগানিস্তানের A, কাশ্মীরের K, সিন্দুর S এবং বেলুচিস্তানের TAN নিয়ে পাকিস্তান (Pakistan) নামক রাষ্ট্রের নামককরণ করেন।


১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে কংগ্রেস এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কিন্তু কংগ্রেস যেসব প্রদেশে ক্ষমতায় ছিল, সেসব প্রদেশে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাতে থাকে। এ পরিস্থিতি ১৯৩৮ সালে করাচিতে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভায় আলোচিত 'দ্বিজাতিতত্ত্ব' (Two Nation Theory) প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ সময় জিন্নাহ ঘোষণা করেন, ধর্ম, সমাজ, কৃষ্টি সবকিছুতেই হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি। সুতরাং তাদের আবাসভূমিও হবে ভিন্ন। ১৯৪০ সালে লীগের লাহোর অধিবেশনে এ. কে. ফজলুল হক ভারতের উত্তরপশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পৃথক রাষ্ট্রসমূহ (States) গঠনের প্রস্তাব করেন। এভাবে উপমহাদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মতানৈক্য, শাসনতান্ত্রিক অরাজকতা যখন তীব্রতর হচ্ছিল, এমন পরিস্থিতিতে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন পাসের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সিলেট জেলাসহ পূর্ববাংলা, পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নব প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে অভিষিক্ত হন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url