হজ পালনের নিয়ম ও হজের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত কী কী?

আসলামু আলাইকুম। হজ পালনের নিয়ম ও হজের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত কী কী? আমরা অনেকেই হজ করার জন্য হজের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত সমূহ জানতে চাই, হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি এবং হজ বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে সম্মানিত হজ পালন করতে হবে। বলা হয় থাকে, হজ জন্মের পর নিষ্পাপ শিশু হওয়ার মতো একটি ইবাদত। হজ পালন প্রতিটি মুসলমানদের জন্য গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। হজ পালনের নিয়মগুলি বিভিন্ন বাধ্যতামূলক, সুপারিশকৃত এবং সুন্নত কর্মকে অন্তর্ভুক্ত করে যা এই পবিত্র হজ যাত্রীকে নির্দেশ করে। নিম্মে হজ পালনের নিয়ম কিভাবে একজন হজ পালন করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি হজ পালন করবেন এবং হজের ফরজ, হজের ওয়াজিব ও হজের সুন্নত কী কী? তা নিম্মে রয়েছে।

হজ পালনের নিয়ম ও হজের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত কী কী ?

হজ পালনের নিয়ম

ইসলামের প্রতিটি আনুষ্ঠানিকতা নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন করতে হয়। হজ করাও নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে করতে হয়। হজ পালনের গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস বা নিয়মগুলো পর্যায়ক্রমে নিচে উল্লেখ করা হলো:

ইহরাম: ইহরাম একটি আরবি শব্দ যার অর্থ 'নিষিদ্ধ'। নামাজ পড়ার জন্য যেমন "তাহরিমা" প্রয়োজন, তেমনি হজের জন্যও ইহরাম বাঁধা আবশ্যক। এটি হজ করার আনুষ্ঠানিক নিয়ত বা ইচ্ছা। শাওয়ালের ১ তারিখ থেকে ৯ই জিলহজ্জ পর্যন্ত যে কোনো দিন ইহরাম বাঁধা যায় । অন্য কোন দিনে ইহরাম বাঁধা জায়েয নয়। এ সময় হজ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি এবং কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ইহরামের পোশাক পরতে হবে এবং উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করতে হবে। যদি কেউ হজ মৌসুম ব্যতীত অন্য যেকোন সময় মক্কায় কা'বা পরিদর্শন করার সংকল্প করে, তবে তাকে হজের ইহরাম পরিধানের এলাকায় মীকাত পৌঁছানোর পরই তাকে  ইহরাম বাঁধতে হবে।

আরও পড়ুন : তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম ও নিয়ত দোয়া এবং আমলসমূহ। 

তাওয়াফ-ই-কুদুম (আগমন তাওয়াফ)

ইহরাম পরিধান করে মক্কায় পৌঁছে সাতবার পবিত্র কাবা শরীফ প্রদক্ষিণ করতে হয়। মক্কায় আগমনের পর এটিই প্রথম "তাওয়াফ। এ কারণে একে 'তাওয়াফ-ই-কুদুম' বা আগমনের তাওয়াফ বলা হয়। তাওয়াফ শুরু হয় "হাজরে আসওয়াদ" (কালো পাথর) থেকে।

সাঈ :

আগমনী তাওয়াফ শেষ হলে পবিত্র কাবা শরীফের সন্নিকটে অবস্থিত সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে সাতবার মধ্যবর্তী পথ অতিক্রম করতে হবে। একে বলা হয় 'সাঈ' যা সাফা পাহাড় থেকে শুরু হয় এবং মারওয়া পাহাড়ের সাথে শেষ হয়। তারপর, ইহরাম পরা অবস্থায়, একজনকে ৭ই জিলহজ্জ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এই সময়ে, "তাওয়াফ করলে তাকে  'নফল ' তাওয়াফ বলে এই তাওয়াফ যতবার খুশি করা যায়। এই 'নফল তাওয়াফ' করলে প্রচুর সওয়াব পাওয়া যায়।

জিলহজ্জের ৭ই তারিখ

ইমাম (ধর্মীয় নেতা) এই দিনে জোহরের নামাজের পর 'খুৎবা' প্রদান করেন। এখানে তিনি বর্ণনা করেন, বিশেষ করে ৮ই জিলহজ্জ মিনায় এবং ৯ই জিলহজ্জ আরাফাতে হজের প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা নিয়ম-কানুন সম্পর্কে বর্ণনা করেন। 

৮ই জিলহজ্জ

এদিন সূর্যোদয়ের পর হজযাত্রীরা মিনায় আসেন। সুন্নাত আনুষ্ঠানিকতা অনুসারে, গোসল করে ইহরামের পোশাক পরে হাজীরা মিনায় যাওয়ার আগে মসজিদুল হারাম বা বায়তুল্লাহ যান। তারা ইহরাম বাঁধার সাথে সাথে তালবিয়া পাঠ করতে করতে মিনায় যায় এবং হজ্জের নিয়ত করে। সেখানে পরের দিন পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া 'সুন্নাত' কাজ।

আরও পড়ুন : শবে বরাতের নামাজের নিয়ম ও নিয়ত এবং দোয়া ও আমলসমূহ। 

৯ই জিলহজ্জ

৯ তারিখ আরাফাতের দিন। এদিন হজযাত্রীরা মিনায় ফজরের নামাজ পড়ার পর সেখানে অবস্থানের জন্য আরাফাতের ময়দানে রওয়ানা হওয়া শুরু করেন। এখানে যোহর ও আসরের নামায যোহরের সময় এবং আসরের সময় উভয় নামাজ ইমামের পিছনে পড়তে হবে। নামাজের আগে, ইমাম খুৎবা প্রদান করেন এবং হজের অবশিষ্ট আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে আলোচনা করেন। এমনকি আরাফাতের ময়দানে অবস্থান হজ কারিদের জন্য একটি ফরজ কাজ। 

জিলহজ্জের ৯ তারিখে বা অনিবার্য পরিস্থিতিতে, পরের রাতে ফজরের আগে এক মুহূর্তের জন্য হলে ও আরাফার ময়দানে অবস্থান করতে হবে । তা না হলে হজ হবে খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ। এদিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে হাজীদের আরাফাত থেকে মুজদালিফার দিকে ফিরতে হয়। অতঃপর মুযদালিফা পৌছে ইশার নামায একত্রে এশা ও মাগরিব উভয় নামায আদায় করতে হবে। এ রাত মুজদালিফায় কাটাতে হয়।

১০ই জিলহজ্জ

দশম দিন হলো "কুরবানীর "  দিন। সেদিন সূর্যোদয়ের আগেই হজযাত্রীরা মিনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করতে হবে । মিনার একটি স্থানে শয়তানের প্রতীক হিসেবে একের পর এক তিনটি কংক্রিটের স্তম্ভ রয়েছে। সেখানে পৌঁছে তারা শয়তানের প্রতিমূর্তি লক্ষ্য করে সাতটি ছোট পাথর (ছোলা-মটরের আকারের মতো) নিক্ষেপ করতে হবে। ইব্রাহিম (আ.) যখন তার একমাত্র প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে (আ.) কোরবানি দিতে যাচ্ছিলেন তখন আল্লাহর নির্দেশে শয়তান পিতা ও পুত্রের মনে সন্দেহ জাগিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। বিরক্ত হয়ে তারা শয়তানকে পাথর ছুড়ে মারে। তীর্থযাত্রীরাও পাথর নিক্ষেপ করে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং কর্তব্যপরায়ণতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য হাজীগণ এই পাথর নিক্ষেপ করে থাকেন।

হজযাত্রীরা পাথর নিক্ষেপের পর মিনায় কোরবানি করতে হবে। কুরবানির পর  মাথা হাজীগণ মাথা কামিয়ে তারপর ইহরাম থেকে মুক্ত হন। বিকল্পভাবে, তারা সমান আকারের তাদের চুল কাটতে পারে। ব্যতিক্রম হলে, মেয়েদের চুলের অগ্রভাগের  সামনের অংশ থেকে কিছুটা চুল কাটলেই চলে। তারপর ওই তারিখে বা ১২ কিংবা ১৩ তারিখে মক্কায় ফিরে এসে তারা 'তাওয়াফ' করতে হবে অর্থাৎ পবিত্র কা'বা শরীফ প্রদক্ষিণ করবে। হজের 'ফরজ' হিসেবে স্বীকৃত এই 'তাওয়াফ'কে 'তাওয়াফ-ই-জিয়ারাত' বলা হয়। এটি হজের একটি ফরজ কাজ। 

মক্কায় প্রথমে পৌঁছে কেউ যদি সাফা ও মারওয়ায় সাঈ না করে তবে তাকে এই তাওয়াফের পর সাঈ করতে হবে। আগে এটি করা হয়ে গেলে আর প্রয়োজন হয় না। এরপর হজযাত্রীদের মিনায় ফিরে যেতে হবে এবং জিলহজের ১১ ও ১২ তারিখে সেখানে অবস্থান করতে হবে।

১১ এবং ১২ তারিখ বিকেলে পৌঁছানোর পর  হজযাত্রীদের মিনায় তিনটি স্তম্ভের প্রতিটিতে সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করতে হবে । তারা ইচ্ছা করলে ১২ তারিখে মক্কায় ফিরে আসতে পারেন। যদি কেউ মিনায় অবস্থান করে তবে তাকে ১৩ তারিখ দুপুরের পর তিনটি স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপ করে মক্কায় ফিরে যেতে হবে। এভাবে হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। মক্কার বাইরে থেকে আসা হজযাত্রীদের তাদের শেষ কাজ হলো বিদায়ী তাওয়াফ করা। কার্যকলাপ হিসাবে প্রত্যাবর্তনের সময় 'তাওয়াফ-উল-বিদা' বা 'বিদায়ীতাওয়াফ' নামেও পরিচিত এই বিদায়ী তাওয়াফ শেষ করতে হবে। এটি মক্কার বাইরের হাজীদের জন্য 'ওয়াজিব' (ফরজের পাশে)।

আরও পড়ুন : উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ ও উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায়। 

হজ পালনের ত্রুটি এবং তা সংশোধনের উপায় 

হজ পালনের সময়, হজযাত্রীরা কিছু ভুল করতে পারে বা অনিচ্ছায় কিছু নিয়ম ত্যাগ করতে পারে। এই ত্রুটিগুলির মধ্যে, কিছু গুরুতর এবং আবার কিছু সাধারণ শ্রেণীর। হজের ওয়াজিব পালন করার সময় যদি ধারাবাহিকতার ব্যতিক্রম বজায় না থাকে, তাহলে 'দম' ওয়াজিব হয়ে যায়। যেমন: মাথার চুল কাটার আগে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা। 'দম' একটি ছাগল বা ভেড়া বা  দুম্মবা কুরবানী করা। এটা গরু বা উট বা মহিষের সাত ভাগের স্থলাভিষিক্ত  হতে পারে। সাধারণত, ইহরাম বাঁধার সময় কেউ যদি পবিত্র হারাম শরীফ এলাকায় কোন হারাম কাজ বা নিষিদ্ধ করে করে তবে তাকে প্রতিদান হিসেবে 'দম' বা কুরবানী করতে হবে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে 'সাদকা' দেওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।

হজ পালনের ত্রুটি এবং তা সংশোধনের উপায় হজ পালনের সময়, হজযাত্রীরা কিছু ভুল করতে পারে বা অনিচ্ছায় কিছু নিয়ম ত্যাগ করতে পারে। এই ত্রুটিগুলির মধ্যে, কিছু গুরুতর এবং আবার কিছু সাধারণ শ্রেণীর। হজের ওয়াজিব করার সময় যদি ক্রম বজায় না থাকে, তাহলে 'বাঁধা' করা ওয়াজিব হয়ে যায়। যেমন মাথা মুণ্ডন বা চুল কাটার আগে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা। এবং 'বাঁধ' একটি ছাগল বা ভেড়া বা ভেড়া বলি দিতে নির্দেশ করে। এটা গরু বা উট বা মহিষের সাত ভাগের ভাগও হতে পারে। সাধারণত, ইহরাম বাঁধার সময় কেউ যদি পবিত্র কাবা এলাকায় কোন হারাম কাজ করে তবে তাকে প্রতিদান হিসেবে 'বাঁধ' বা কুরবানী (কুরবানী) করতে হবে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে 'সাদকা' (গরিবদের উপহার) দেওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।

আরও পড়ুন : ছেলেদের ইসলামিক নাম অর্থসহ। 

হজের ফরজ কয়টি ?

হজের ফরজ কাজ হলো তিনটি। 

  • হজ করার নিয়তে 'ইহরাম' বাঁধা।
  • জিলহজির ৯ তারিখে আরাফাতের (ওকুফ) ময়দানে অবস্থান করা। 
  • তাওয়াফে যিয়ারত করা। 

হজের ওয়াজিব কয়টি ?

হজের ওয়াজিব কাজ হলো সাতটি।

  • আরাফাত থেকে ফেরার পথে মুজদালিফায় অবস্থান করা।
  • 'সাফা' এবং 'মারওয়া' পাহাড়ের মাঝখানে দৌড়ানো বা সাঈ করা।
  • শয়তানের দিকে পাথর নিক্ষেপ করা (জামরাতুল আকাবায়)।
  • মক্কার বাইরে থেকে আগত হাজীদের বিদায় কালীন তাওয়াফ করা (তাওয়াফ-ই-বিদা) সম্পন্ন করা। একে "তাওয়াফুল বিদা' (বিদায়ী তাওয়াফ)ও বলা হয়।
  • মাথা কামানো বা চুল কাটা।
  • কোরবানি করা। 
  • 'দম' সম্পাদন করা।

হজের সুন্নাত সমূহ 

হজের জন্য অনেক সুন্নাত কাজ রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি নিম্নে দেওয়া হল: 

  • মক্কার বাইরে থেকে আগত হাজীদের দ্বারা তাওয়াফ-ই-কুদুম (আগমন তাওয়াফ) করা।
  • হাজারে আসওয়াদ (কালো পাথর) থেকে তাওয়াফ শুরু করা।
  • ৭ই জিলহজ্জে মক্কায় হজে ইমাম (ধর্মীয় নেতা) কর্তৃক হজ সম্পর্কে 'খুৎবা' প্রদান করা, ৯ই জিলহজ্জে বিকেলে আরাফাতে আবার খুৎবা প্রদান করা,  জিলহজ্জের ১১ তারিখে মিনায় 'খুৎবা' প্রদান করা।
  • ৮ জিলহজ এ মক্কা থেকে মিনার উদ্দেশে রওনা করা মিনায় উপস্থিত থেকে জোহর থেকে ৯ জিলহজের ফজর পযন্ত অবস্থান করা ও ৫৮ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা। 
  • ৯ জিলহজ এ সূর্য ওঠার পর মিনা থেকে আরাফার দিকে রওনা। 
  • সম্ভব হলে আরফায় গোসল করা। 
  • ইহরাম বাধার আগে গোসল করা। 
  • মুজদালিফায় রাত কাটানোর পর ফজরের নামাজ আদায় করা ও সূর্য ওঠার পূর্বে  মিনার দিকে রওনা করা। 
  • জিলহজ মাসের ১১ ও ১২ তারিখে কংকর নিক্ষেপ (রামি) এর জন্য মিনায় রাত্রিযাপন করা। 
  • জিলহজ মাসের ১১,১২ ও ১৩ তারিখে ক্রমধারা ঠিক রেখে কংকর নিক্ষেপ করা। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url