মে দিবস রচনা ও মে দিবসের ইতিহাস । দি ডেইলি লার্ন
রচনা মে দিবস ও মে দিবসের ইতিহাস সংকেত : ভূমিকা — মে দিবসের ইতিহাস—শ্রমিকের অসন্তোষের কারণ—শ্রমিকের সংগ্রাম—শ্রমিক ধর্মঘট ও আন্দোলন—আন্দোলনের পরিণতি—মে দিবসের লক্ষ্য—বিভিন্ন দেশে মে দিবস—দিবসটির তাৎপর্য—বিজয়ের সুফল—উপসংহার।
- মে দিবসের তাৎপর্য
- বিশ্ব শ্রমিক দিবস
- মে দিবসের গুরুত্ব
- মে দিবসের শিক্ষা
মে দিবস রচনা ও মে দিবসের ইতিহাস । দি ডেইলি লার্ন
ভূমিকা : ‘মে দিবস' (May Day) হচ্ছে ইংরেজি মে মাসের প্রথম তারিখ। এ দিনটা বিশ্বের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিন। দিনটির সাথে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের মহান আত্মত্যাগের ঘটনা জড়িত। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের উন্নত জীবন-যাপনের লক্ষ্যে আত্মবলিদানের এ ঘটনার সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করে সারাবিশ্বে দিনটি পালিত হয়। এ দিবসটি শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ হওয়ার বিরল ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পুঁজিবাদী শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকের এ আন্দোলন ছিল একটি চমৎকার বিজয়। দিবসটি তাই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
মে দিবসের ইতিহাস : ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে কর্মবিরতি ও রাজপথে বিক্ষোভ মিছিলে নেমেছিল। সে দিন এসব মেহনতি মানুষের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এই গুলিতে শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয় পীচঢালা রাজপথ। কিন্তু গুলি খেয়েও তার পিছপা হালা না। রক্তের বিনিময়ে শিকাগো শহরের শ্রমিক জনতা তাদের ন্যায্য দাবি আদায় করে নিলো। দাবি আদায়ের এই সূত্র ধরে পর্যায়ক্রমে দৈনিক আটঘণ্টা কাজের দাবি সারা দুনিয়া জুড়ে স্বীকৃতি লাভ করলো। তাই ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছরই ১লা মে-কে মে দিবস হিসেবে বিশ্বের শ্রমিক সমাজ উদযাপন করে আসছে।
আরো পড়ুন : দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান রচনা।
শ্রমিকের অসন্তোষের কারণ : শ্রমিক সমস্ত দিন অমানুষিক পরিশ্রম করে শিল্প সৃষ্টি করে, কিন্তু বিনিময়ে তার ভাগ্যে জোটে নামমাত্র মজুরি। সেই মজুরিতে পেট ভরানোর মতো রুটিটুকু জোটানো সম্ভব হয় না; অথচ তারই তৈরি শিল্পে মুনাফা ভোগ করে মালিকের গাল হয় লাল। অন্তরের চাপা বিক্ষোভ একদিন আগ্নেয়গিরির লাভা নিঃস্রাবের মতো প্রকাশিত হলো আমেরিকার হে মার্কেটে মে দিবসের এক সূর্যকরোজ্জ্বল দিনের আলোয়।
শ্রমিকের সংগ্রাম : শ্রমিক চেয়েছে বাঁচতে, সামান্যতম মানবিক অবস্থা নিয়ে বাঁচার জন্য সেদিন তারা যে সংগ্রাম করেছিল, সেই সংগ্রামের জয় তাদের মনে এনে দিয়েছিল দুর্জয় সাহস ও অপরিমেয় প্রাণশক্তি। মে দিবসের ইতিহাস শ্রমিকের জীবনে নতুন সূর্যোদয়ের ইতিহাস। শ্রমিকের মে দিবসের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের রক্তক্ষরা কাহিনী দুনিয়ার মজুরদের মধ্যে এনে দিয়েছিল সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা, তাদের বুকে জাগিয়েছিল বিপ্লবের চেতনা। তাদের মধ্যে এনে দিয়েছিল আত্মবিশ্বাসের অমোঘ মন্ত্র।
শ্রমিক ধর্মঘট ও আন্দোলন : ১৮৫৬ সালের মে মাসে অস্ট্রেলিয়ায় দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ ও ৮ ঘণ্টা বিশ্রামের দাবিতে প্রথম শ্রমিকেরা সংঘবদ্ধ হয়ে ধর্মঘট করে; তারও কয়েক বছর পর ১৮৬২ সালের মে মাসে হাওড়া স্টেশনে রেলশ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আর একটি ধর্মঘট হয়। শ্রমজীবী মানুষেরা সেদিনও সংঘবন্ধ হতে পারে নি; তাই তাদের ধর্মঘটে সেদিন সাড়া জাগে নি। অত্যাচারী মালিকপক্ষ বিদ্রুপের হাসি হেসে সেদিনও শ্রমিকদের চাবুক দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একই দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠে। ১৮৮৬ সালের মে মাসে সমগ্র আমেরিকা জুড়ে ঐ দাবিতে শ্রমিকেরা সোচ্চার হয়ে উঠে এবং তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
আরো পড়ুন : ইন্টারনেট ও আধুনিক প্রযুক্তি রচনা।
আন্দোলনের পরিণতি : ১৮৮৬ সালে আমেরিকার মালিকদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ১ মে তারিখে শিকাগোর সমস্ত শ্রমিক সমবেত হয় 'হে মার্কেট স্কোয়ারে'। শ্রমিকদের সংঘবদ্ধতা নষ্ট করার জন্য মালিকপক্ষ চক্রান্ত করেও ব্যর্থ হন। পুলিশের গুলি বর্ষণে ছয়জন শ্রমিক নিহত এবং অগণিত শ্রমিক আহত হয়। শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা এনে ফাঁসি দেওয়া হয় স্পাইজ, এঞ্জেস, ফিসার ও পার্সনকে। মে দিবসের সেই অমানবিক স্মৃতি পৃথিবীর শ্রমিক গোষ্ঠী ভুলতে পারেনি। ১৮৯০ সালের ১লা মে তারিখকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মে দিবস পৃথিবীর অগণিত মানুষের রক্তের ইতিহাস বহন করে এসেছে; তাই এই দিবসটির একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে শ্রমিক শ্রেণির কাছে।
মে দিবসের লক্ষ্য : অর্থনৈতিক পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে ফেলার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে তারা এবং শেষ পর্যন্ত সমস্ত সংগ্রামেই তারা জয়ী হয়েছে। বৈপ্লবিক গণঅভ্যুত্থান, যুদ্ধ বিরোধী ও ফ্যাসিবিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে মে দিবসের এক বলিষ্ঠ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। প্রতি বছর মে দিবসে শ্রমিকেরা তাদের সংহতির শপথ গ্রহণ করে এবং এই শপথকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সমগ্র বিশ্বের নিপীড়িত সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির অভ্যুত্থান ও সংহতি এবং বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলন। তাই শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি আন্দোলনে এই মে দিবসের ঐতিহ্য সমাজের সকল স্তরের মানুষকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে এবং সর্বহারার মুক্তি সংকল্পে এক অফুরন্ত প্রেরণার উৎস জুগিয়েছে।
বিভিন্ন দেশে মে দিবস : প্যারিস সম্মেলনে ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন দেশে মে দিবস পালিত হয়। ১৯৯০ সালে গ্রেট ব্রিটেনে ১ মে'র পরিবর্তে ৪ মে হাইড পার্কে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে প্রথম আন্তর্জাতিক মে দিবস উদ্যাপিত হয়। আমেরিকায় ১৮৯০ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক মে দিবস পালিত হয় ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘটের মাধ্যমে। ফ্রান্সে মিছিল ও সমাবেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে মেতে পালিত হয় ১৮৯০ সালে। জার শাসিত রাশিয়ায় ১৮৯৬ সালে মে দিবস উদযাপিত হয় ধর্মঘটের ভেতর দিয়ে। চীনে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৪ সালে। ডা. সান্ ইয়াৎ সেন ওই সমাবেশে ভাষণ দেন। এডলফ হিটলারের উত্থানের শুরুতে ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে কমিউনিস্টরা বেআইনি মে দিবস উদযাপন করেছিলেন। আজ এশিয়া আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ল্যাটিন আমেরিকা, ছোট বড় সমস্ত দেশ জুড়ে মে দিবস পালিত হচ্ছে।
আরো পড়ুন : শিষ্টাচার রচনা | (২০ পয়েন্ট) অষ্টম, এসএসসি, এইচএসসি।
দিবসটির তাৎপর্য : মে দিবস এখন আর কোনো বিশেষ দেশের গুটিকয়েক শ্রমিকের জীবন দেওয়ার ঘটনা নয়, এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে সারাবিশ্বের শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ। শোষণের বিরুদ্ধে ন্যায্য দাবি আদায়ের দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রত্যয়। এ সংগ্রামের ফলে ট্রেড ইউনিয়ন করা অধিকার এবং এই ইউনিয়নের মাধ্যমে মালিকের সাথে দর- কষাকষিতে ভিন্ন মত দেখা দিলে শ্রমিকদের ধর্মঘট করা অধিকার সারাবিশ্বে আজ স্বীকৃত। মে দিবসের এই চেতনা শ্রমিকদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এখন তারা আর মালিকের হাতের ক্রীড়ণক নয়। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও' স্লোগানের মাধ্যমে শ্রমিকরা যেমন সহজেই সংঘবদ্ধ হতে পারছে তেমনি দাবি আদায়ের প্রেরণায়ও তারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
বিজয়ের সুফল : মে দিবস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হওয়ায় শ্রমিকদের বিজয় হয়েছে। বিশ্বে পুরোপুরি শ্রমিক শোষণের অবসান না ঘটে থাকলেও কঠোরতম শোষণের হাত কিছুটা হলেও শিথিল হয়েছে। শ্রমিকরা কারখানায় আট ঘণ্টার বেশি শ্রম দিলে ওভারটাইম দাবি করতে পারছে। শ্রমিকরা আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত হতে পেরেছে, মানুষ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ আন্দোলনে বিজয়ের ফলে শ্রমিকরা উন্নত জীবন-যাপনের পথের সন্ধান লাভ করেছে। বিনামূল্যে ছেলে- মেয়েদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ইত্যাদি লাভের সুযোগ পেয়েছে এবং শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য মালিকপক্ষ অনুরূপ আরো সুযোগ-সুবিধা দিতে বাধ্য হয়েছে। অপরদিকে অনুন্নত দেশের শ্রমিকরা নানা বঞ্চনা, প্রতারণা ও অবহেলার শিকার হলেও তাদের মাঝে আন্দোলনের চেতনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রতি বছর মে দিবস পালন করছে তারা নতুন করে শপথে উজ্জীবিত হওয়ার প্রেরণায়।
উপসংহার : মে দিবস শ্রমিকদের চিন্তা ও চেতনাকে জাগ্রত করে তোলার দিবস। যদিও অনুন্নত দেশগুলোর কারখানার মালিকদের শোষণ এখনো বন্ধ হয় নি তবুও তারা সারাক্ষণই শ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে রয়েছে। তাদেরও উচিত শ্রমিকদেরকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করা এবং তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার মেনে নেওয়া।
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url