শিষ্টাচার রচনা | (২০ পয়েন্ট) অষ্টম, এসএসসি, এইচএসসি।
শিষ্টাচার রচনা | (২০ পয়েন্ট) অষ্টম, এসএসসি, এইচএসসি।
- আদব-কায়দা/ শিষ্ঠাচারিতা
- ছাত্রজীবনে শিষ্টাচার ও সৌজন্যতা
- মিতাচার/মিতাচারের প্রয়োজনীয়তা
- জীবনের জন্য শিষ্টাচার
- জীবন গঠনে শিষ্টাচার
- সৌজনাবোধের প্রয়োজনীয়তা
ভূমিকা : আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মার্জিত ও ভদ্র আচরণই শিষ্টাচার। আরবিতে একে আদব-কায়দা বলা হয়। বিনয় মানুষের মাথার মুকুট। বিনয় শিষ্টাচারের সার্থক বহিঃপ্রকাশ। মানুষের পরিচয় তার মনুষ্যত্বে। মনুষ্যত্ব ছাড়া মানুষ আর ইতর প্রাণীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মানুষ সৌন্দর্যের জন্য পোশাকপরিচ্ছদ আর অলঙ্কার পরে। তেমনি আত্মার অলঙ্কার শিষ্টাচার। শিষ্টাচারী হতে কোনো সম্পদ লাগে না। চলনে-বলনে মার্জিত আচরণ প্রকাশ হলো শিষ্টাচার। শিষ্টাচারী লোককে সবাই ভালোবাসে। শিষ্টাচার ব্যক্তিকে সমাজে বিশিষ্ট করে তোলে। তাকে সবাই ভালোবাসে।
শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ কী?/বা স্বরূপ : 'শিষ্ট' শব্দের আভিধানিক অর্থ “ভদ্র' বা 'মার্জিত' আর 'আচার' শব্দের অর্থ ব্যবহার। সুতরাং 'শিষ্টাচার' শব্দের অর্থ দাঁড়ায় শুদ্র বা মার্জিত ব্যবহার। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের আত্মীয়- অনাত্মীয়, পরিচিত-অপরিচিত সকলের সাথে রুচিপূর্ণ প্রীতিময় ব্যবহারের নাম শিষ্টাচার। এতে সকলে বিমোহিত, প্রীত হয়। সৌজন্য বলতে কেবল প্রীতিময় ব্যবহারই নয় এটা সামাজিক রীতি অনুসরণ করে স্মৃতিময় করতে হয়। যেখানে থাকবে মহৎ প্রাণের গভীর ছোঁয়া, বৃহত্তর মহিমা প্রকাশের সৌন্দর্যের বিকশিত অন্তর। যাতে সকলে মুগ্ধ হয়। সকলে আকর্ষণ বোধ করে।
আরও পড়ুন : ছাত্র জীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা রচনা।
শিষ্টাচারের মাধ্যম : আমরা জানি শিষ্টাচার মানুষের মার্জিত আচরণিক রূপ। আমরা আমাদের প্রতিটি কাজকর্মে এ শিষ্টাচারের বিকাশ ঘটাতে পারি। যেমন- মাথার চুল কাটা থেকে পায়ের নখ কাটা এবং তা ভদ্রোচিত কাটা। পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন থাকা, মানুষের সাথে সুন্দর শুদ্ধ ভাষার কথা বলা, সবার সাথে আদব রক্ষা করা, পোশাক-আশাকে উন্নত রুচির পরিচয় দেয়া, সময়ের মূল্য দেয়া, লেখাপড়ায় ভালো ফলাফল করা, সৎ পথে থাকা, সত্য কথা বলা ইত্যাদি সবই নিউাচার প্রকাশের মাধ্যম। বদমেজাজ, অসঙ্গত পোশাক, উদ্ধত ব্যবহার, দুর্বিনীত আচরণ কখনো শিষ্টাচারের অঙ্গ হতে পারে না।
শিষ্টাচার শেখার উপায় : পরিবার শিষ্টাচার অর্জনের সূতিকাগার। পিতা-মাতা, ভাই-বোন এবং অন্যান্য আত্মীয়- বজনের কাছ থেকে শিশুরা সর্বপ্রথম শিষ্টাচার অর্জনের পাঠ নিয়ে থাকে। শিশুরা সাধারণত অনুকরণ প্রিয়। এক্ষেত্রে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা যদি শিষ্টাচারী হয় তাহলে শিশুরাও তা শিখে নিতে পারে। শিশুরা স্বভাবতই সবকিছু শিখতে চায়। তাদের কেবল নির্দেশনার প্রয়োজন। শিষ্টাচার শেখার দ্বিতীয় ক্ষেত্র বিদ্যালয়। শিক্ষকদের দায়িত্ব শিশুদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়া। তৃতীয় ক্ষেত্র সমাজ, সামাজিকতা পরিবেশ থেকে শিশুরা শিষ্টাচারের নির্দেশনা নিতে পারে।
মানবজীবনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব : মানবজীবনে শিষ্টাচারের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। সমাজে কারো কারো সাথে ভাব বিনিময় করতে হয়। সমাজে বাস করতে হলে কেবল নিজের প্রতি খেয়াল রাখলেই হবে না, অপরের সুখ ও স্বার্থের প্রতিও খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। এই স্বার্থ উদ্ধার করতে হলে শিষ্টাচারী হতে হয়। দুর্বিনীত, রুক্ষভাষী দুর্ধর্ষকে কেউই পছন্দ করে না। তার অনেক শত্রু সৃষ্টি হয়। সামাজিক শান্তি, শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য রক্ষা করার জন্য প্রত্যেকের যত্নসহকারে ভদ্রতা অনুশীলন করা প্রয়োজন। ভদ্রতা আত্মীয়তার চেয়ে কম এবং সামাজিকতার চেয়ে কিছু বেশি। কিন্তু যারা অশিষ্ট, তারা মনে করে শিষ্টাচার ভীরুতা বা দুর্বলতার লক্ষণ। তাদের এ ধারণা ভুল। কারণ, সকলের সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে অসাধারণ বুদ্ধি, বিবেচনা শক্তি, রুচির পরিচয় দিতে হয়। প্রাপ্য সম্মান উপযুক্ত ব্যক্তি প্রীতিকর ভাব নিয়েই দিতে হয়। ভদ্রতা আত্মীয়তার মতো আন্তরিকতায় গভীর নয় কিংবা সামাজিকতার মতো কেবল লোক দেখানো বা বাধ্যবাধকতা নয়। শিষ্টাচার বা সৌজন্য সামাজিক মানুষের অলঙ্কার এবং অহঙ্কার। শিষ্টাচার ও সৌজনা সারা জীবনের সাধনায় সিদ্ধি লাভের ফসল। এগুলো ক্রয় করা যায় না, এগুলো শ্রম দিয়ে অর্জন করতে হয়। এগুলো জীবনের ঐশ্বর্য। যে মানুষ এ ঐশ্বর্য যতো বেশি অর্জন করতে পারে সে ততো ভদ্র ও বিনয়ী বলে বিবেচিত হয়। যে সমাজে এই মানুষের সংখ্যা বেশি সে সমাজ ততো সভ্য।
আরও পড়ুন : শ্রমের মর্যাদা রচনা।
ছাত্রজীবনে শিষ্টাচার : ছাত্রজীবন অধ্যয়নের সময়। এটা সকল বিষয় শেখার সময়। ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের প্রস্তুতি হিসেবে ছাত্রজীবন। তাই ছাত্রজীবনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব রয়েছে। অত্যন্ত দুর্বিনীত ও দুর্ধর্ষ ব্যক্তি সুশিক্ষা ও সৎসঙ্গের কারণে অভ্যন্ত কৃষ্টিবান ও শিষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। ছাত্রজীবনের উপর নির্ভর করে ভবিষ্যৎ জীবনের সফলতা বা বিফলতা। ছাত্রজীবনে যে ছাত্র শিক্ষকদের কাছে উদ্ধত, বন্ধুদের কাছে বেদনার মূর্ত প্রতীক, রূঢ় তার আচরণে পরিবারের সবাই ক্ষুদ্ধ হয়; সে পরবর্তী জীবনে হয় ঘুষখোর, দুর্নীতিপরায়ণ এবং পাপাচারী। তাই সে নিজেকে তিল তিল করে শেষ করে দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজেকে সুন্দর ও সার্থকতায় পরিপূর্ণ মানুষ করে গড়ে তোলার ব্রত অনুষ্ঠানের জায়গা। এটাই মানব হৃদয়ের মহিমান্বিত সুকুমারবৃত্তির পাপড়িগুলো বিকশিত করে দেয়। সৌরভে ভরিয়ে দিয়ে পরবর্তী সময়ে চন্দনের কাঠ তৈরি করে। শিষ্টাচার ও তন্ত্রতার জন্যই কেবল অর্জন করা যায়, হারাতে হয় না কিছুই। উন্নতি আর প্রগতির পথ বেয়ে পৌঁছে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করে। শিক্ষকদের কাছ থেকে ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা অর্জন করে আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়। যারা এর থেকে বঞ্চিত তারা সার্থপর, নিষ্ঠুর, দুর্দম, কু-প্রবৃত্তির লোক, অশুভ শক্তি। অন্ধকারের গহ্বরে এরাই দেশকে ঠেলে দেয়। অন্যায়-অসত্যের চোরাপথের অন্ধকারে। সেই গহিন অন্ধকারে কেবল ব্যক্তিই হারিয়ে যায় না. সমাজে দেখা যায় বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, অবিচার, অন্যায়, বর্বরতা যা নরকে পরিণত হয়। কারণ, "Courtesy costs nothing but buys everything. (সৌজন্যতায় কোনো খরচ নেই এবং বরং কেনা যায় সবকিছু।) সৌজন্যবোধ মানুষকে অনেক মহৎ এবং চরিত্রবান করে তোলে।
সামাজিক রীতি ও শিষ্টাচার : মানুষের শ্রেষ্ঠতম সম্পদের ক্রম যোগফল শিষ্টাচার। তাতে যে সমাজে যতো সত্য লোক আছে সে সমাজ ততো সত্য। আজ সমাজে সৌজন্য আর ভদ্রতার চিত্র অত্যন্ত করুণ। যে চিত্র আমরা পাই তা সমাজে অত্যন্ত নিষ্ঠুর। দিনে দিনে বাড়ছে মানুষের ঔদ্ধত্য, উচ্ছৃঙ্খলতা। শ্রদ্ধেয়দের অশ্রদ্ধা, পুরাতনের পরিহার, তাই বিরোধ। দেখা দিচ্ছে, দেশ সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিত্তবানদের ঔদ্ধত্য, শক্তিমানের অত্যাচারের জন্যেই। অবিনয় আজকাল আর লজ্জা নয়। বিনয়, ভদ্র, সৌজনা, সৌন্দর্যবোধ হারিয়ে নিঃষ।
আরও পড়ুন : আমাদের গ্রাম রচনা।
শিষ্টাচার ও খোশামোদ বা তোষামোদ বৃত্তি : সত্যকে সত্য, ন্যায়কে ন্যায়, কালোকে কালো বলাই শিষ্টাচার। শিষ্টাচারীর দৃষ্টি নিজেকে অসুবিধায় রেখে অপরকে সুবিধা দেয়া আর খোশামোদির কাজ অপরকে অসুবিধা করে হলেও নিজের স্বার্থ উদ্ধার করা। এরা অত্যন্ত জঘন্য, হীনমনা। তোষামোদি হলো আত্মসুখ, আত্মষার্থ, সৌন্দর্যহীন, কুটিল, একটি আরেকটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জটিল, অপরাধ, অন্যায়। অপরদিকে বিনয়ী, নম্রতা, ভদ্রতা, দয়া, নিয়মানুবর্তিতা সবই শিষ্টাচারের বৈশিষ্ট্য। এগুলো
চক্ষুলজ্জা ও শিষ্টাচার : অসত্য, অন্যায়, দুর্নীতি মেনে নেওয়া শিষ্টাচার নয়। এসব ক্ষেত্রে অন্তত চক্ষুলজ্জা থাকতে হবে। এটা দুরারোগ্য সামাজিক ব্যাধি। শিষ্টাচারী হতে হলে চারিত্রিক দৃঢ়তা থাকতে হবে।
শিষ্টাচারের সুফল : শিষ্টাচার মানুষকে বিনয়ী, ভদ্র, পরিশীলিত ও মার্জিত করে। মানুষের কাছে নিজেকে গ্রহণীয় করে তোলে। ফলে তারা নন্দিত হয়। এটি মানুষকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সামাজিক সম্প্রীতি স্থাপিত হয়। সর্বত্র জয়ডঙ্কা বাজে। মোটকথা শিষ্টাচারীর শত্রু বন্ধুতে পরিণত হয়। পৃথিবীর অনেক খ্যাতিমান লোক চিরশত্রুকেও এই গুণ দ্বারা চির আপন করেছেন। এমন অনেক উদাহরণ আছে।
শিষ্টাচার হীনতার কুফল : শিষ্টাচারহীন ব্যক্তি সমাজের দুষ্ট কীট। শিষ্টাচারহীন ব্যক্তির মধ্যে কর্কশ বাক্য, উদ্ধত আচরণ, বড়দের প্রতি অশ্রদ্ধা, শিক্ষকদের সাথে দুর্বিনীত ব্যবহার করা, বাপ-মাকে অবহেলা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। শিষ্টাচারহীন ব্যক্তি বন্ধুত্ব, অন্তরঙ্গতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ থেকে বঞ্চিত হয়। সর্বোপরি সে মানুষের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়; সর্বজন কর্তৃক নিন্দিত হয়। লোকসমাজে সে হেয় প্রতিপন্ন হয়।
উপসংহার : চরিত্ররূপী সুরম্য অট্টালিকা শিষ্টাচার ও সৌজন্যের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে। তাই তো সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে শিষ্টাচারের বিকল্প নেই। শিষ্টাচারী ব্যক্তি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদ। কারণ, তিনি সকলের কাছে নন্দিত-বন্দিত। অপরদিকে অভদ্র অশিষ্ট ব্যক্তি সকলের কাছে নিন্দিত ও ধিকৃত। আর তাই সকলের উচিত শিষ্টাচার ও সৌজন্য অনুশীলন করার মাধ্যমে তা অর্জন করা। তাহলে আমরা সভ্য জাতি হিসেবে গর্বের সাথে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url