নবজাতক শিশুর যত্ন - শিশুর জন্মের পর প্রয়োজনীয় টিপস্
একটি শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য নবজাতকের যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সঠিক যত্ন তাদের শারীরিক, মানসিক এবং জ্ঞানীয় বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। এবং তাদের মধ্যে এটি একটি শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম তৈরি করতে সাহায্য করে, পিতামাতা এবং শিশুর মধ্যে বন্ধনকে বাড়িয়ে তোলে এবং নবজাতকের সাধারণ অসুস্থতা প্রতিরোধ করে। প্রাথমিক যত্ন একটি নবজাতকের মঙ্গল এবং ভবিষ্যতের জন্য তাদের সঠিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করে।
নবজাতক শিশুর যত্ন - শিশুর জন্মের পর প্রয়োজনীয় টিপস্
১. সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য নবজাতককে প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধই খাওয়াতে হবে। একফোঁটা চিনি, মধু, পানি বা অন্যকোন দুধ; কিছুই খাওয়ানো যাবে না। নবজাতককে রোগমুক্ত রাখার জন্য মাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। দুধ খাওয়ানোর আগে-পরে এবং যত্ন নেওয়ার সময় মাকে অবশ্যই হাত ধুয়ে নিতে হবে।
আরো পড়ুন: টিকাদান কর্মসূচী - নবজাতকের টিকার তালিকা।
২. নবজাতকের দু-তিনদিন বয়স থেকে প্রতিদিন গোসল করানো ভালো। গোসলের পানি ফুটিয়ে গরম করে তা আবার কুসুম গরম অবস্থায় ফিরিয়ে এনে সেই পানিতে গোসল করাতে হবে। রোদে গরম করা পানি শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কারণ সে পানি থেকে জীবাণু দূর হয় না।
৩. নবজাতককে গোসলের আগে-পরে তেল মাখার দরকার নেই। তবে শীতের সময় তেল মাখানো যেতে পারে। তেল মাখানোতে শিশু এবং মায়ের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়।
৪. নবজাতককে পাউডার দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
৫. শিশুর চোখে কাজল দেয়া যাবে না। এতে চোখের ক্ষতি হতে পারে।
৬. শিশুকে ফিডার খাওয়ানোর দরকারই নেই। এই ফিডার তার জীবনের কোনো পর্যায়েই কাম্য নয়।
৭. নবজাতকের নাভির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি যত্নবান হতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চার নাভি যেনো শুকনা, পরিষ্কার এবং খোলা থাকে। কাপড় বা অন্য কিছু দিয়ে নাভি ঢেকে রাখা যাবে না। নাভি যদি শুকনো পরিষ্কার রাখা হয়, তবে তাতে আলাদা করে কোনো অ্যান্টিসেপটিক লোশন, পাউডার দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
৮. জন্মের পরপরই বিসিজি, ওর্যাল পোলিও এবং সম্ভব হলে হেপাটাইটিজ বি ভ্যাকসিন দিতে হয়। এগুলো দেয়া বাচ্চার শরীরের জন্য ভালো। যে কোনো থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিসিজি এবং ওর্যাল পলিও দেয়া হয়।
৯. নবজাতকের রক্তক্ষরণ রোধে ভিটামিন'কে-১ ইনজেকশন দুটি ডোজ মুখে খাওয়াতে হবে। এর প্রথম ডোজটি জন্মের পরপর এবং দ্বিতীয় ডোজটি জন্মের পাঁচ থেকে সাত দিন বয়সের মধ্যে দিলে নবজাতকের অস্বাভাবিক রক্ত ক্ষরণের সম্ভাবনা কমে।
১০. গোসলের ক্ষেত্রে মাসে এক-দুবার নবজাতকের জন্য বিশেষভাবে তৈরি সাবান ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সাবান ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
১১. নবজাতককে প্রথম এক মাস বালিশ দেয়ার দরকার নেই। তখন তার ঘাড়ের নিচে কাঁথা বা ন্যাকড়া দিয়ে এক ইঞ্চি পরিমাণ মোটা কিছু দিতে হবে। এতে নবজাতকের ঘাড় শক্ত হয়।
আরো পড়ুন: শরীর দুর্বল হলে করণীয় কি।
১২. নবজাতককে ক্যারিয়ারে নেওয়াটা উচিত নয়। মায়ের কোলে নিলে বাচ্চা নিরাপদ থাকে, ঠাণ্ডা লাগার সম্ভাবনা থাকে না। মায়ের সঙ্গে বাচ্চার নিবিড় সম্পর্ক হয় এবং মায়ের বুকের দুধের পরিমাণও বাড়ে। প্রযুক্তির যত উন্নয়নই হোক না কেন, নবজাতককে প্রাকৃতিক উপায়ে লালন-পালন করাই আমাদের কর্তব্য।
১৩. আপনার শিশুটি যখন পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে খেলে তখন তার কাজ বা খেলাটি সম্পন্ন করার জন্য তাকে উৎসাহ দান করুন। আপনার শিশুটি আপনার প্রতি আকর্ষিত হবে।
১৪. শিশুর কাজে খেলায় অনবরত হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। এতে শিশুটি আপনার প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠবে এবং আর খেলতে চাইবে না। এ কারণে তার একাগ্রতার মতো সু-অভ্যাসের সম্ভাবনা একেবারেই কমে যাবে।
১৫. শিশুরা কৌতূহলী। তাদের কৌতূহল চরিতার্থ করার সুযোগ দেয়া উচিত। ছোট্টযন্ত্র, ভাঙা কলকব্জা, স্কু ইত্যাদি ধরনের খেলার বিভিন্ন অংশ খুলে এবং আবার জুড়ে শিশুরা অনেক আনন্দ পেয়ে থাকে। এতে তাদের মনোযোগ, উদ্ভাবনী শক্তি এবং অঙ্গ সঞ্চালনের নিপুণতাও বৃদ্ধি পায়। তাই তাদের উৎসাহিত করুন। তবে লক্ষ্য রাখবেন দামি যন্ত্রপাতি যেন না খোলার চেষ্টা করে।
১৬. আপনার শিশুকে সঠিক বয়সে স্কুলে ভর্তি করান। কারণ বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেনগুলো শিশু শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। নার্সারি বিদ্যালয়ে বিভিন্ন খেলার মাধ্যমে শিশু নিজ নিজ রুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজ জীবন ও সুশৃঙ্খলতার শিক্ষা লাভ করে। শারীরিক বিকাশের মতো শিশুর মনের বিকাশেরও পৃথক পৃথক ধাপ রয়েছে। তাই বিকাশোন্মুখ শিশুকে এমন খেলনা দিতে হবে যাতে তার মানসিক চাহিদা পূরণ হয়। শিশুকে গঠনমূলক খেলার উপাদান, যেমন রংতুলি, কাদামাটি, ব্লক ইত্যাদি দিলে শিশুর বিকাশের পথ সুগম হবে এবং বেশি তৃপ্ত হবে।
১৭. যুগ বদলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসিকতারও পরিবর্তন হচ্ছে। কয়েক বছর আগে বাড়ি তৈরি করা হতো জয়েন্ট ফ্যামিলিকে ভিত্তি করে কিন্তু এখন বড়ো জায়গাকে ক্রমশ ছোট করে এনে ছোট ছোট ফ্যামিলির জন্য ছোট ছোট ফ্লাট তৈরি হচ্ছে। এতে করে শিশুরা খেলাধুলা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। খেলার উপকরণের মতো খেলার পরিবেশের প্রতিও আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। শিশুরা যাতে বসে আপন মনে খেলতে পারে এ জন্য ঘরের মধ্যে বেশ কিছু বিস্তৃত জায়গা রাখা উচিত।
১৮. আপনার শিশুকে নতুন নতুন জায়গায় নতুন নতুন পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত করুন। তাতে তার মধ্যে এক ধরনের ভ্রমণ পিপাসু মনের জন্ম নেবে এবং তার মানসিকতাও অনেক উন্নত হবে।
১৯. শিশুকে চাপ প্রয়োগ করে খাওয়ানো একান্তই অনুচিত। শিশুকে জোর করা হলে শিশু ততো বেশি খেতে চাইবে না।
২০. খাওয়ার জন্য শিশুকে বকাবকি বা মারধর করা উচিত নয়।
২১. শিশুকে নিজ হাতে খেতে অভ্যস্ত করুন। এতে প্রথম প্রথম কিছু খাবার নষ্ট হলে তাকে বকাঝকা করবেন না। করলে খাবারের প্রতি তার অনীহা জন্মাবে। কিন্তু উৎসাহ দিলে সে খেতে আগ্রহী হবে।
আরো পড়ুন: শরীর ফিট রাখার 10 টি উপায়।
২২. শিশুকে খাওয়ানোর ব্যাপারে মায়ের অস্বাভাবিক ও মাত্রাতিরিক্ত উদ্বেগ শিশুর ইচ্ছার ক্ষতি করতে পারে।
২৩. ৯-৩৬ মাস বয়সে শিশুদের মধ্যে ব্যক্তিত্ব স্বাতন্ত্র্যবোধ গড়ে ওঠে। এ সময় এরা কারো কর্তৃত্ব সহ্য করতে পারে না। ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিবাদী হয়ে উঠে। এ সময় খাওয়া-দাওয়াসহ যেকোনো কাজে শিশুকে বাধ্য করা ঠিক নয়। এতে শিশুর খাওয়ার অরুচি আরো বেড়ে যাবে। শিশু ক্রমশ রাগী হয়ে উঠবে আর ব্যবহার রূঢ় হবে।
২৪. শিশুকে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার দিতে হবে যাতে খাবারের প্রতি তার আকর্ষণ বাড়ে। প্রতিদিন একই রকম খাবার দিলে শিশুর মাঝে খাদ্যে অরুচি চলে আসে।
২৫. শিশু না খেলেও সে কথা তার সামনে আলোচনা করা ঠিক নয়। এতে তার ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ণ হবে এবং না খাওয়ার ব্যাপারে তাদের জেদ আরো বেড়ে যাবে।
একটি নবজাতকের জন্মের পরে, উপরোক্ত নবজাতক শিশুর যত্ন প্রয়োজনীয় টিপসগুলি প্রতিটি শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় যা তাদের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারা ৷ নবজাতক পর্যাপ্ত ঘুম যাওয়া ও সঠিক খাওয়ানো, হয় বুকের দুধ খাওয়ানো বা ফর্মুলা, পুষ্টি এবং বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সবসময় উষ্ণ রাখা এবং নিরাপদ ঘুমের পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্পূর্ণ। নবজাতক শিশুর যত্ন জন্য নিয়মিত ডায়াপার পরিবর্তন বিভিন্ন সংক্রমণ প্রতিরোধ করে এবং শিশুর শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তার নিশ্চিত করে। নবজাতকদেরও তাদের স্বাস্থ্য এবং বিকাশের নিরীক্ষণের শিশুর জন্মের পর প্রয়োজনীয় ঘন ঘন চেক-আপ করা প্রয়োজন। এই টিপসগুলি অনুসরণ করে, পিতামাতারা তাদের শিশুর জীবনের জন্য একটি সুস্থ নবজাতকের বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে পারেন।
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url