মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ ও রোগ থেকে মুক্তির উপায়
মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ ও মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় বর্তমান সময়ে অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বহুগুনে সহজ হয়ে উঠেছে। মানসিক রোগ বর্তমানের ধারণা অনুযায়ী, বংশ ধারা (জিন) এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জটিল পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ও কর্মক্ষমতার বিপর্যয় ঘটলে মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে।
মানসিক রোগ কত প্রকার ?
মানসিক রোগ ২ প্রকার।
- উদ্বিগ্নতা
- বিষণ্ণতা
উদ্বিগ্নতা
(anxiety neurosis), Depression (বিষন্নতা) ও পাগলামি ও উন্মাদ অবস্থা (Schizophrenia) Schizophrenia: একশত জনের এক জনের হয়। ১৫ বছরের কম বয়সে হয় না। ১৫-৩৫ বয়সে বেশী হয়। অদ্ভুত অনুভূতি ও উপলব্ধি হয়। রোগী শব্দ শুনে চোখে দেখে, স্পর্শ করে কিন্তু বাস্তবে তার ভিত্তি নাই। অনেক ক্ষেত্রে উৎসাহ- উদ্যোম, মনসংযোগ, আত্মত্মসচেতনতা-আত্মোপলব্ধি হারিয়ে ফেলে; জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। উদ্বিগ্নতা চিন্তা বেশী হলে সেটা দুশ্চিন্তা তার চেয়ে বেশী হলে এবং শারিরীক বা মানসিক উপসর্গ হলে সেটা উদ্বেগ। উদ্বেগজনিত ব্যাধির বিভিন্ন ধরনের উপসর্গের মধ্যে আছে- ঘুমের সমস্যা, বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা, হাত-পা ঝিম ধরা বা কাঁপা, ঘাম হওয়া, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, বমিভাব, মাথা ঘোরা এবং পেশি টান পড়া। পাঁচটি প্রধান ধরনের উদ্বেগজনিত ব্যাধি হলো- জেনারেলাইজড অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার, প্যানিক ডিজঅর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার এবং সোশ্যাল ফোবিয়া কিংবা সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার। হিস্টেরিয়ার রোগী নিজের স্বার্থে না জানা রোগের উপসর্গের সৃস্টি করে। দীর্ঘ দিন মানসিক সমস্যা ও চাপে থাকতে থাকতে অনেকের সত্যিই শারিরীক উপসর্গ (সাইকসোমাটিক ডিজঅর্ডার) হয়।
আরও পড়ুন: কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায়।
বিষণ্ণতা
সাধারণভাবে মনে করা হয়, মন খারাপ মানেই বিষণ্ণতা। কিন্তু বিষণ্ণতা বলতে কেবল মন খারাপকে বোঝায় না, এটি মন খারাপের চেয়ে কিছু বেশি। কমপক্ষে দুই সপ্তাহজুড়ে দিনের বেশির ভাগ সময় বিষণ্ণতা থাকলে সেটা ডিপ্রেশন। বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে পাঁচজনের বিষণ্ণতাজনিত সমস্যা আছে। বিষণ্ণতার কারণে মাদকাসক্তি থেকে শুরু করে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ
বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়া মানসিক রোগী চেনার উপায় অনন্য মানুষের জন্য কিছুটা জটিল হতে পারে, কারণ মানসিক রোগের লক্ষণগুলি ব্যক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন ভাবে দেখা যেতে পারে। তবে, কিছু মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ সাধারণ মানসিক রোগের লক্ষণ রয়েছে যেগুলি একজন ব্যক্তি মানসিক রোগী তা চিনতে সাহায্য করতে পারে। এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ রয়েছে :
১. মনোযোগ ও মনসংযোগের সমস্য :যারা কিছু বিষয় চিন্তা করার সময় এক জায়গায় মনোযোগ রাখতে পারে না।
২. মেজাজ পরিবর্তন : বিষণ্নতা, অবহেলা, উত্তেজনা, অথবা অত্যধিক আনন্দ বা খুশি এ ধরনের মেজাজের নিয়মিত পরিবর্তন মানসিক রোগী চেনার উপায় অন্যতম একটি উপায়।
৩. স্বাভাবিক আচরণের পরিবর্তন : কোনো ব্যক্তির যদি আচরণের বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা দেয়, যেমন সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরা, পূর্বের অধিকাংশ কাজগুলোতে আগ্রহ কমে যাওয়া, অস্বস্তির অথবা অস্বাভাবিকভাবে বেশি বা কম কথা বলা—তাহলে এটা মানসিক সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।
৪.মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ : মানসিক সমস্যাগুলি শারীরিক রোগের লক্ষণ যেমন নিঃশ্বাসের সমস্যা, মাথাব্যথা, অথবা ঘুমের সমস্যা সহ কিছু মানসিক রোগ সমূহ দেখা দিতে পারে।
৫. মনের অস্থিরতা : অতিরিক্ত উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, অথবা অস্থিরতা যে কোন মানসিক রোগের লক্ষণ হতে পারে।
৬. স্বচ্ছন্দে সমস্যা : মানসিক রোগের লক্ষণসমূহ দেখা দিলে কিছু মানুষ নিজের স্বচ্ছন্দতা হারাতে পারে, যেমন আগের মতো আনন্দ না পাওয়া, অথবা মনোযোগের সমস্যা অনুভব করা।
৭. হতাশা ও আত্মহত্যার চিন্তা : অত্যধিক হতাশা বা আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা দেখা দিলে তা মানসিক সমস্যার গুরুতর লক্ষণ হতে পারে।
আরও পড়ুন: পায়খানা ক্লিয়ার - কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার ঘরোয়া উপায়।
মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে উপরোক্ত, মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ অথবা মানসিক লক্ষণগুলির মধ্যে কোনো একটি বা সবই মানসিক রোগের কারণ হতে পারে, তবে শুধুমাত্র চিকিৎসক বা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় এবং যথাযথ চিকিৎসা দিতে পারেন। তাই, মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ অথবা মানসিক রোগ সমূহ দেখা দিলে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
মানসিক রোগ কেন হয়
মানসিক রোগ কেন হয়, যদি ও এটা একটা জটিল প্রশ্ন। আমাদের মন ও শরীরের মধ্যে অনেক ধরনের সম্পর্ক থাকে, আর এসব সম্পর্কের সমস্যা থাকলে মানসিক রোগ হতে পারে।
আমাদের মস্তিষ্কে রাসায়নিকের মাত্রা, হরমোনের পরিবর্তন, জেনেটিক ফ্যাক্টর, বা পরিবেশগত চাপ—এসব কারণে মানসিক রোগ হতে পারে। এছাড়াও, আরো কিছু কারণ রয়েছে যা মানসিক রোগের কারণ হতে পারে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা রকম চাপ, যেমন কাজের প্রেশা, পারিবারিক সমস্যা, বা কোনো ধরনের ট্রমা, এসবও মানসিক কারণে ও মানসিক রোগ হতে পারে।
কখনও কখনও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর গবেষণা অনুযায়ী , কোনো ধরণের অসুখ বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ দেখা এবং মানসিক রোগ হতে পারে।
মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায়
মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর কিছু শারীরিক চিকিৎসা ও মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজ। তবে, চিকিৎসার ক্ষেত্রে তা যেন মানসিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর পরামর্শ অনুযায়ী, এখানে কিছু সাধারণ উপায় রয়েছে যা মানসিক রোগ থেকে মুক্তির জন্য সহায়ক হতে পারে:
১. চিকিৎসা ও থেরাপি
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ: একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (Psychiatrist) বা মানসিক স্বাস্থ্য থেরাপিস্ট (Psychologist) আপনার সমস্যার সমাধানে সহায়তা করতে পারেন। সেটা হোক থেরাপি অথবা ঔষধ তা ডাক্তার এর পরার্মশ অনুযায়ী সমাধান করা যথার্থ। এ ছাড়াও কিছু বিশেষজ্ঞদের পরার্মশ থেরাপি অথবা ঔষধ এর পাশাপাশি ডাক্তার এর পরার্মশ :
১. লাইফস্টাইল পরিবর্তন
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: নিয়মিত একটি নিদিষ্ট সময়ে ব্যায়াম করা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, এবং পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে সাহায্য করতে পারে।
- স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: স্ট্রেস কমানোর জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে পারেন, যেমন যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, বা শ্বাস প্রশ্বাসের অনুশীলন।
২. সমর্থন ও সামাজিক সহায়তা
- পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তা: আপনার পরিবার এবং বন্ধুদের সহায়তা মানসিক রোগের মোকাবেলায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা আপনার অনুভূতি বুঝতে এবং এই সময়ে আপনার সাথে ভালো সময় দিয়ে সাপোর্ট করতে পারে।
- মানসিক সাপোর্ট গ্রুপ: মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পেতে একটি সাপোর্ট গ্রুপে যোগদান অভিজ্ঞতা শেয়ার এবং সমাধানের পথ খুঁজে পেতে সাহায্য পাওয়া যায়।
৩. আত্মসচেতনতা ও শিক্ষার উন্নয়ন
- আত্মসচেতনতা: নিজের অনুভূতি এবং চিন্তা সম্পর্কে সচেতন হওয়া যা মানসিক সমস্যা উত্তরণের অন্যতম একটি ধাপ।
- মানসিক রোগের শিক্ষা: মানসিক রোগের লক্ষণ, এবং এর কারণ, চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জানলে ভালোভাবে মানসিক রোগ মোকাবেলা করা যায়।
৪. নিজের প্রতি সহানুভূতি
- স্ব-সহানুভূতি: নিজেকে বুঝতে পারা এবং নিজের প্রতি সহানুভূতি থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং মনের শান্তির জন্য নিজেকে সময় দেওয়া একটি সঠিক সিদ্ধান্ত।
- পছন্দ অনুযায়ী কাজ: নিজেকে নিয়ে সৃজনশীল কার্যকলাপ, শখ, বা পছন্দের কাজের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে পারে। তাই, অনন্য কাজের এটি করা উচিত।
প্রত্যেক মানুষের জন্য মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় বা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রকারভেদ ভিন্ন হতে পারে, তাই সর্বোত্তম উপায় এবং যথার্থ চিকিৎসা নিতে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ।
মানসিক রোগের চিকিৎসা
সব মানসিক রোগের চিকিৎসা করা যায়, যা অধিকাংশ মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সাহায্য করে। মানসিক রোগের ধরন অনুযায়ী ওষুধ, সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিং ও অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। তীব্র বিষণ্ণতার জন্য গুরুতর ক্ষেত্রে কখনও কখনও ইলেক্ট্রোকনভালসি থেরাপি (ইসিটি) ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। মানসিক রোগের চিকিৎসা একটি দলগত প্রচেষ্টা বা টিমওয়ার্ক। ওষুধ কাজ করে রাসায়নিক পদার্থ বা নিউরোট্রান্সমিটারের ওপর, সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং কাজ করে জ্ঞানীয় বিকাশ (কগনিশন), আচরণ ও মনের গড়নের উপর।
আরও পড়ুন: অর্শ বা পাইলস এর লক্ষণ ও ঘরোয়া চিকিৎসা।
মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ভালোভাবে জীবন যাপন করতে পারেন এবং অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হতে পারেন (যেমন স্বাভাবিক জীবন যাপন করা, কাজ করা, লেখাপড়া করা, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা প্রভৃতি)। মানসিক রোগ অন্যান্য শারীরিক রোগের মতোই। মানসিক ওষুধের ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ আছে। Anxiolytics উদ্বেগ জনিত রোগ এবং এর সাথে সম্পর্কিত সমস্যা যেমন অনিদ্রা জনিত রোগের জন্য ব্যবহৃত হয়। মুড স্টেবিলাইজার মূলত বাইপোলার ডিসঅর্ডারের জন্য ব্যবহৃত হয়। এন্টিসাইকোটিক্স সাইকোফ্রেনিয়ার (Schizophrenia) ইতিবাচক উপসর্গের জন্য ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু ওষুধ সেবনের পর যখন উপসর্গ কমে যায়, তখন রোগী বা তার আত্মীয়স্বজন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ বন্ধ করে দেয়। ফলে চিকিৎসা সঠিক হয় না এবং কিছুদিন পর রোগ ফিরে আসে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ বদলানো যাবেনা, ডোজ পরিবর্তন করা যাবেনা, বন্ধ করা যাবেনা। এগুলো খেলে ব্রেনের ক্ষতি হয় না, ব্রেন নষ্ট হয়ে যায় না, মস্তিষ্ক ও স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে।
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url