পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা সংকেত : ভূমিকা—পরিবেশের স্বরূপ বা পরিবেশ—পরিবেশ দূষণের কারণ— জনসংখ্যা বৃদ্ধি— বনসম্পদের ক্ষতি/বনসম্পদ শূন্যতা ও মরুকরণ—রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার—যুদ্ধ ও সংঘর্ষ— বায়ুদূষণ— শব্দদূষণ — পানিদূষণ- মাটিদূষণ— গ্রিন হাউজ এফেক্ট— রাসায়নিক দ্রব্যের অপব্যবহার — বিপর্যয়মুক্ত পৃথিবী অথবা দূষণের প্রতিকার -সমাধানের চেষ্টা/ধরিত্রী সম্মেলন—উপসংহার।
- পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
- পরিবেশ দূষণ ও বাংলাদেশ
- দূষিত পরিবেশ বিপন্ন পৃথিবী
- আধুনিক বিশ্বে পরিবেশ দূষণ ও প্রতিকার
- পরিবেশ দূষণ ও জনসংখ্যা
- গ্রিন হাউজ এফেক্ট ও বাংলাদেশ
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা
ভূমিকা : কবির ভাষায়,
“মানুষ আত্মভেদী, আত্মনাশী নীল পতঙ্গ
একদিন পাঁজরের হাড় দিয়ে গড়েছিল এ পৃথিবী
একদিন মানুষই ধ্বংস করবে তাকে।”
—কবিতার এ ছত্রেই লুকিয়ে আছে বিশ্ব পরিবেশের পরিণতির কথা। সৃষ্টির আদি লগ্নে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য ছিল। প্রকৃতি ও পরিবেশের মাঝেই বিচিত্র জীবনের বিকাশ ঘটে। পরিবেশের জন্যই মানুষ ভালো-মন্দ হয়। পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজন শান্তিময় সুস্থ পরিবেশ। বেঁচে থাকার জন্য যে পরিবেশের প্রয়োজন, সে পরিবেশ নানা কারণে জটিল আকার ধারণ করেছে। মানুষ তার আবিষ্কারের প্রতিভা, পরিশ্রম আর দক্ষতা নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা পদ্ধতি সংগ্রহ করেছে। বিজ্ঞান ক্রমবিকাশের ধারায় চরম উন্নতি লাভ করেছে। আর মানুষ সেই গৌরবে অন্ধ হয়ে পৃথিবীর সুন্দর পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছে। সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী দূষণের মাত্রা মারাত্মক আকার ধারণ করছে। তাই বিশ্বব্যাপী মানুষ আজ পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে।
পরিবেশের স্বরূপ বা পরিবেশ : আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে যেমন, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, গ্রাম-গঞ্জ, বিল- ঝিল সবকিছু মিলেই পরিবেশ। মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবনাচরণ, জীবনধারণ পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারে সমাজ দ্বারাও পরিবেশ প্রভাবিত হয়। আমাদের এ পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। আর এ সব পরিবেশগত সমস্যা। যার জন্য এ দেশে মাঝে মাঝে সাইক্লোন হানা দেয়, আবার অগ্নিবৃষ্টি নিয়ে আসে খরা, মাঠঘাট ডুবিয়ে দেওয়ার বাসনা নিয়ে আসে অতিবৃষ্টি, সর্বোপরি পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টি মিলিয়ে আবির্ভূত হয় সর্বগ্রাসী বন্যা। আর এ সব সমস্যা দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে এখন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এ পরিবেশগত সমস্যার জন্যেই একদিকে যেমন জীবন বিপন্ন তেমনি পৃথিবীর চালিকা শক্তি অর্থনীতি হয় হুমকির সম্মুখীন।
পরিবেশ দূষণের কারণ : বিভিন্ন কারণে পরিবেশ দূষিত হতে পারে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো :
১. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ,
২. বনশূন্যতা ও মরুকরণ,
৩. রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, ৪. যুদ্ধ ও সংঘর্ষ,
৫. বায়ুদূষণ,
৬. শব্দ দূষণ,
৭. পানি দূষণ,
৮. মাটি দূষণ,
৯. গ্রিন হাউজ এফেক্ট এবং
১০. রাসায়নিক দ্রব্যের অপব্যবহার ইত্যাদি।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি : পরিবেশের হুমকির জন্য যে কারণটা প্রথমেই চিহ্নিত তা হলো জনসংখ্যা আশাতীতভাবে বৃদ্ধি। কারণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে তার চাহিদা, বাসস্থান, শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র, চিত্তবিনোদনসহ সকল ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পায়। তাতে সঙ্কট দেখা দেয়। যেভাবে জনসংখ্যা বেড়ে চলছে তাতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে বাধ্য। বিশ্বের যে কোনো মেগাসিটির দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। এমনকি আমাদের ঢাকা শহরের দিকে তাকালেই দেখতে পাই পরিবেশ কীভাবে নষ্ট হয়। মেগাসিটি ঢাকার বর্তমান পরিবেশ শোচনীয়। সর্বত্র মানুষ আর মানুষ। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা, রাস্তা-ঘাট অপর্যাপ্ত। অন্যান্য সব কিছুই চাহিদার তুলনায় অল্প। আর এর জন্য দায়ী হলো অধিক জনসংখ্যা।
বনসম্পদের ক্ষতি/বনসম্পদ শূন্যতা ও মরুকরণ : পরিবেশের দূষণের আর একটি কারণ হলো বৃক্ষ নিধন যার পরিণাম মরুকরণ। জ্বালানি কাঠ এবং ঘরের আসবাবপত্র হিসেবে অযথা বনভূমি ধ্বংসের ফলে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। সবুজ বনানি হারিয়ে পৃথিবী হয়ে উঠছে মরুময় আর তাই দেখা দিচ্ছে কখনো অতিবৃষ্টি, আবার কখনো অনাবৃষ্টি। আমরা কেবল বনভূমি হারাচ্ছি না। তার সাথে সাথে ধ্বংস হচ্ছে হাজার হাজার প্রাণী ও উদ্ভিদ। পৃথিবীতে যে হারে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে তা প্রতি দশ বছরে ভারতের আয়তনের সমান।
আরও পড়ুন: মানব কল্যাণে বিজ্ঞান রচনা।
রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার : আমরা ভালো ও উন্নত ফসল ফলানোর জন্য সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে থাকি। কীটপতঙ্গের হাত থেকে ফসল ফলানোর কীটনাশক অপরিকল্পিত ও ব্যাপক হারে ব্যবহার করার ফলে জীবজগৎ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। বিশেষ করে পাখি ও মাছ হুমকির সম্মুখীন। অন্যান্য প্রাণিগুলোও এর শিকার হচ্ছে। যুদ্ধ ও সংঘর্ষ : যুদ্ধ মানুষের কেবল জীবন হরণকারী নয়, যুদ্ধের বিভীষিকাময় স্বাক্ষর বহন করছে হিরোশিমা, নাগাসাকি ও ভিয়েতনাম। পরমাণু অস্ত্র, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ফলে পরিবেশ মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে। তাই পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে যুদ্ধ ও সংঘর্ষ।
বায়ুদূষণ : মুক্ত বায়ু মানুষের জীবনের দরকার কিন্তু কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, হাইড্রোজেন ক্লোরাইড, হাইড্রো-কার্বনসমূহ, সালফারের অক্সাইডসমূহ, ফটো কেমিক্যাল অক্সিডেন্ট, অ্যাশবেন্টাস, বেরিলিয়ান, পারদ, ভিনাইল ক্লোরাইড বায়ুকে দূষণ করছে। যার ফলে পরিবেশ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন।
শব্দদূষণ : বর্তমানে শব্দ দূষণের প্রধান উৎস হলো গাড়ির হর্ন, যানবাহনের শব্দ, মাইকের শব্দ, কল-কারখানার নির্গত শব্দ, নির্মাণ কাজের উড়োজাহাজের শব্দ, প্রচণ্ড জনকোলাহলের শব্দ, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ইত্যাদির শব্দ। এসব শব্দ প্রচণ্ডভাবে পরিবেশ দূষিত করছে। অথচ শব্দদূষণের ফলে মানুষের শ্রবণ ক্ষমতা লোপ পায় এবং রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে মানসিক বিপর্যয় দেখা দেয় ।
পানিদূষণ : পানিদূষণের ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। জৈব আবর্জনাসমূহ, উদ্ভিদের পুষ্টিকর পদার্থসমূহ, অঙ রাসায়নিক পদার্থ, তেজস্ক্রিয় পদার্থসমূহ এবং তেলবাহী জাহাজের তেল সাগরে পড়ে পানি দূষিত হচ্ছে। ফলে পরিবে চরমভাবে দূষিত হচ্ছে।
মাটিদূষণ : পরিকল্পনাহীনভাবে নগর সভ্যতার বিকাশ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগর, আবর্জনা শিল্প আবর্জনা, তেজরি আবর্জনা, খনিজ আবর্জনা মাটিকে দূষিত করছে যা পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আরও পড়ুন: দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান রচনা।
গ্রিন হাউজ এফেক্ট : গ্রিন হাউজ এফেক্ট বলতে আমরা বুঝি সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছায় একটা নির্দিষ্ট বায়ুমণ্ডল তিনি করে, সূর্যের আলো সহজে পৃথিবীতে আসে কিন্তু সমস্ত বিকিরণ মহাকাশে ফিরে যেতে পারে না। তাই বায়ুমণ্ডলের উচ্ছ্বসি বেড়ে এ প্রক্রিয়ায় আগামি ২০৫০ সালে ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সমুদ্রের তলদেশের পানি বৃদ্ধি পাবে ১ মিটার তাহলে পৃথিবী থেকে মালদ্বীপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বাংলাদেশের দশ শতাংশ ও মিসরের মতো দেশ ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাবে। আমেরিকা, কানাডাসহ প্রেইরি অঞ্চল মরুভূমি হবে, ৭০ লা বর্গমাইল এলাকার মোট জলরাশির ৭৫% পানি যে বরফ আছে তা গলতে শুরু করবে। সমুদ্রের লোনা পানি নদ-নদীর দিকে আসবে। তাতে পরিবেশ জীবনের জন্য সুখকর হবে না।
রাসায়নিক দ্রব্যের অপব্যবহার : পরিবেশের বৈরী অপদ্রব্যগুলো সিসা, পারদ, সালফার ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি। কাঠ কণা থেকে শুরু করে ভারী ধাতু নিউক্লিয়ার আবর্জনা, ক্লোরো ফ্লোরো মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি পরিবেশ দূষিত করছে। এর ফলে আবহাওয়ার তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে।
বিপর্যয়মুক্ত পৃথিবী অথবা দূষণের প্রতিকার : মানুষ পরিবেশের উপাদান; সৃষ্টির সেরা জীব। তাই প্রতিকার করা একান্তভাবে যে কোনো সুস্থ মানুষের জন্য কাম্য। গ্রিন হাউজ এফেক্ট রোধ করা যেমন দরকার তেমনি কল-কারখানার ধোঁয়া, গাড়ির শব্দ, রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবে এ ব্যাপারে সম্মিলিত চেষ্টার দরকার। তবে জরুরি ভিত্তিতে যে পদক্ষেপগুলো নিতে হবে, তাহলো :
১. জাতীয় পরিবেশ নীতির সফল বাস্তবায়ন করে আইনগত কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে।
২. বন সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।
৩. নিরাপদ পানির ব্যবহার, বনভূমির পরিমাণ বাড়াতে হবে। এবং
৪. পরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ ও শিল্প কলকারখানা স্থাপন করতে হবে।
সমাধানের চেষ্টা/ধরিত্রী সম্মেলন : ১৯৯২ সালের ৩ জুন থেকে ১৪ জুন ব্রাজিলের রাজধানী শহর রিও-ডি-জেনিরোতে পরিবেশ বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন হয়। এ সম্মেলনে ১৮৫টি দেশের সাড়ে তিন হাজার ও জাতিসংঘের সাতশো প্রতিনিধির সামনে একটি বিপন্ন উদ্ভিদ, প্রাণী, মাইক্রো বায়োলোজিক্যাল প্রজাতিসমূহ ও বায়ুমণ্ডল রক্ষার জন্য এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ সম্মেলনে ইউএন ডি ই ডি-র সেক্রেটারি উন্নত, কম উন্নত বিশ্বের বৈষম্য ভুলে গিয়ে আগামী প্রজন্মের জন্য অধিকতর নিরাপদ বিশ্ব রচনা করার উদাত্ত আহ্বান জানান। নরওয়ের প্রধানমন্ত্রি তার 'Our Common Future রিপোর্টে বিপন্ন বিশ্বকে নতুন করে রক্ষার কথা বলেন। রিও সম্মেলনে বিশ্বের তাপমাত্রা রোধ, বিলুপ্তপ্রায় প্রাণিকুল রক্ষা এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন রক্ষাকল্পে জীব-বৈচিত্র্য সনদ ও জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষর করে। সারাবিশ্ব এখন ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালন করে এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে নিউইয়র্কে Earth Summit + 5 সম্মেলনের আয়োজন করে পরিবেশ বিপর্যয় রোধের প্রচেষ্টা চালানো হয়। এভাবেই বর্তমানে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ইন্টারনেট ও আধুনিক প্রযুক্তি।
উপসংহার : আজ আমরা ধ্বংসলীলার চিতার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সভ্যতা মানুষের কল্যাণে আসে। তিল তিল করে অদম্য কর্ম আর হাজার বছরের সভ্যতার গতি কোন্ দিকে? সৃষ্টির না ধ্বংসের। তার উত্তর ধ্বংস, অবশ্যই ধ্বংসের। তাই আমাদের আজ এখুনি ব্যবস্থা নিতে হবে এ পৃথিবীকে রক্ষার, তার পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে সুন্দর মনোরম চিন্তাকর্ষক করার। আর তাই কবি সুকান্তের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সকলকেই বলতে হবে—
‘চলে যাব তবু যতোক্ষণ দেহে আছে প্ৰাণ,
এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি,
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল। নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।'
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url