বাংলা রচনা : একটি শীতের সকাল

  • গ্রামবাংলার শীতের সকাল রচনা 
  • শীতের সকাল রচনা 
  • শীতকাল রচনা 
  • শীতের মিষ্টি রোদে একটি শীতের সকাল রচনা 

বাংলা রচনা : একটি শীতের সকাল

একটি শীতের সকাল রচনা সংকেত: ভূমিকা— শীতের আগমন —সূর্যোদয়ের পূর্বে শীতের সকাল—শীতের সকালের ভাবরূপ—শীতের সকালের বৈরাগ্য মূর্তি—শীতের সকাল —শহুরে শীতের সকাল—শীতের উপভোগ ও খাবার-দাবার উপসংহার।

siter sokal rachana

ভূমিকা : একটি বছরে ছয়টি ঋতু আমাদের দেশে আবর্তন করে। গ্রীষ্ম-বর্ষায়, শরৎ-হেমন্তে, শীত-বসন্তে বাংলা প্রকৃতি, মানুষ ও জীব-জন্তুর জীবন বিচিত্র ও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। ঋতু পরিবর্তনে ধারণ করে এক একটি রূপ। সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে একের পর এক ঋতু তার আপন মহিমাময় অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। বিভিন্ন ঋতুতে সকাল ও বিকাল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে। শীত এখানে তার ফুল, ফল ও ফসলের ঘ্রাণ নিয়ে সৌন্দর্য উৎসব করে জীবনের পশরা সাজিয়ে দোরগোড়ায় হাজির হয়। কুয়াশামোড়া পাতা ঝরা সকালে মানব মনে বিচিত্র অনুভূতির সঞ্চার হয়। তখন শীত উদাসী বাউল, হাতে একতারা, যেখানে থাকে বৈরাগ্যের সুর। শীতের নিরানন্দের কুয়াশার চাদর জড়িয়ে দেয়। তখন শীতে এসে যায় পাবণ, মেলা ইত্যাদি। তাই কবিগুরু তার কবিতায় বলেন,

“এসেছে শীত গাহিতে গীত বসন্তেরি জয়,

যুগের পরে যুগান্তরে মরণ করে নয়।”

—তাই আমরা দেখি বসন্তের আগমনবার্তা ঘোষণা করে শীত।

শীতের আগমন : অগ্রহায়ণের ফসল কাটার পর শূন্য মাঠে কুয়াশায় ঢেকে শীত এসে যায়, সাধারণত পৌষ ও মাঘ এই দু মাস শীতকাল। প্রকৃতপক্ষে, হেমন্ত থেকে শীতের সূচনা আর বসন্তের মাঝামাঝি পর্যন্ত শীত থাকে। উত্তরে হিমেল হাওয়ায় শীত জেঁকে বসে। বন-বনানীর বুকে গাছের ঝরা পাতায় বেজে ওঠে এক বিষাদময় সুরধ্বনি—

“আমলকী বন কাঁপে যেন তার বুক করে দুরু দুরু;

পেয়েছে খবর পাতা খসানোর সময় হয়েছে শুরু।”

সূর্যোদয়ের পূর্বে শীতের সকাল : লেপের তলা হতে উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে হয় না। শিয়রে হিংস্র শীত কেশর ফুলিয়ে, থাবা পেতে বসে আছে। গরম বিছানার স্বরচিত উত্তাপ ছেড়ে উঠতে গেলে কেমন এক দুর্নিবার আলস্য সমস্ত চেতনাকে ঘিরে ধরে। তন্দ্রা বিজড়িত চেতনায় দূর বনান্তরাল হতে পাখিদের কল কূজন শোনা যায়, আর শোনা যায় পথচারীদের বাতাসে ভেসে আসা দু' একটি সংলাপ অথচ চারদিকে পৃথিবী এত আশ্চর্য নিস্তব্ধতায় মত্ত। এ সীমাহীন বিষণ্ণতা ও বৈরাগ্যে সকলের হৃদয় কানায় কানায় ভরে উঠেছে। শূন্যতাই বুঝি তার সঠিক পরিচয়। শীতের সকালে তাই এক নিঃসীম জড়তা সকলের চেতনাকে আচ্ছন্ন রাখে। কর্মের আহ্বান সত্ত্বেও এক সূদূর ব্যাপ্ত নৈষ্কর্মের জড়তায় মানুষ আরামের শয্যায় পড়ে থাকে এবং কল্পনা করতে পারে শীতের বুড়ি কুয়াশার কম্বল গায়ে দিয়ে আগুন পোহাবার জন্য শুকনো পাতা কুড়াতে বনের ভেতর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে চলেছে।

আরও পড়ুন: দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান রচনা

শীতের সকালের ভাবরূপ : পূর্ব দিগন্তে ধীরে ধীরে আলো ফুটতে থাকে। উত্তর দিক হতে হিমগর্ভ ঠাণ্ডা বাতাস এক দীর্ঘশ্বাসের মতো হঠাৎ শির্ শির্ করে বনের গাছগুলোর পাতার ফাঁক দিয়ে বয়ে যায়। পাতারা সহসা কাঁপে ওঠে। টুপটাপ করে করে শিশির ঝরে পড়ে। বনের পথ শিশিরে সিক্ত। টিনের চালে, ঘাস দূর্বা আর লতাপাতায় শিশির বিন্দু জমে ভোরের আলোয় ঝলমল করছে। দূরে কোথাও খেজুর রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। বাতাসে লোভনীয় মিষ্ট গন্ধ ভেসে আসছে। একজন ফেরিওয়ালা মুড়ি এবং অপর একজন নলের গুড়ের পাটালি হেঁকে গেলো। গ্রামের রাস্তায় কৃষাণেরা বদল হাঁকিয়ে মাঠের দিকে ছুটেছে। মুগ, মসুর, ছোলা, কলাই ইত্যাদি বুননের জমি প্রস্তুত করছে কৃষকেরা। সরিষার ক্ষেত্রে মৌমাছিদের গুঞ্জরণ শুরু হয়েছে। দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ সরিষা ফুল। দূরে গ্রামের পাঠশালায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এক বিচিত্র সুর করে নামতা, কবিতা ইত্যাদি পাঠ শুরু করেছে। চারদিকের এই কর্মব্যস্ততার মধ্যে বিছানায় পড়ে পড়ে আলস্যে তন্দ্রাসুখ উপভোগ অনুচিত বোধ হল, এমন সময় খেজুর রস পানের আহ্বান পেয়ে সকাতরে গায়ের লেপ সরিয়ে বিছানা ছাড়লাম।

শীতের সকালের বৈরাগ্য মূর্তি : ততোক্ষণে বাইরের পৃথিবীর ঘুম ভেঙ্গেছে। দিকে দিকে কর্মের মুখরতর শীতের সকাল কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে। পূর্ব দিগন্তে আলো ছড়িয়ে সূর্যের রথ আকাশ পরিক্রমায় বের হয়ে পড়েছে। নীলকণ্ঠ পাখি রিক্তপত্র বাবলার ডালে বসে রৌদ্র পোহাচ্ছে। এক জোড়া ফিঙে মনের আনন্দে সকালের আলোয় হাবুডুবু খাচ্ছে। খঞ্জনা পাখিটি ডানায় বাতাস কেটে কেটে কুয়াশা সাতরিয়ে কোথায় উড়ে গেলো। শীতের সকাল যেন এক প্রৌঢ়া কুলবধূ। তার সলজ্জ মুখখানি দিগন্ত বিস্তৃত কুয়াশার অবগুণ্ঠনে ঢাকা। ধূমল কুয়াশার অবগুণ্ঠনে মুখ ঢেকে সে দিগন্তের গা ঘেঁসে ধীর মন্থর পায়ে চলতে থাকে। তার করুণ বিষণ্ণ চোখ দুটি। লজ্জাবনত মুখখানি দেখা যায় না। তার আপাদমস্তক কুয়াশার গাঢ় আবরণে আবৃত। বেলা বাড়তে থাকে শীতের সকাল তার কুয়াশার অবগুণ্ঠন ধীরে ধীরে খুলতে থাকে। তার বৈরাগ্য ধূসর অঙ্গ হতে শুভ্র সুষমা ত্যাগের মহিমা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সে তার সমস্ত সঞ্চয় নিঃশেষ উজাড় করে দিয়ে ধারণ করেছে এক সর্বত্যাগিনী তাপসী মূর্তি। দুই চোখে তার এক বিষণ্ণ প্রশান্তি। সে কুড়াতে জানে না, সংগ্রহ জানে না, জানে কেবল ছড়াতে, উড়াতে, বিলাতে।

আরও পড়ুন: শ্রমের মর্যাদা রচনা। 

শহুরে শীতের সকাল : শহরের মানুষ ঘুমায় দেরিতে, আবার ওঠেও দেরিতে। ফলে সকালবেলা তারা বিছানায় কাটায়। তাদের নৈসর্গিক দৃশ্যের সাথে পরিচয় হয় না। দেখা হয় না প্রকৃতির অনাবিল প্রাণবন্ত মনমাতানো পরিবেশ। তাদের জীবন রুটিন বাঁধা। কিবা শীত কিবা গ্রীষ্ম বাজারের ব্যাগ হাতে সকালে পথ মাড়াতে হয়। অথবা নাস্তার টেবিলে গরম কাপড়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা থাকে। কোট-কাচারি অফিস-আদালতে সময়মতো পৌঁছানো চাই। যান্ত্রিক সভ্যতায় তারা ব্যস্ত। ইটের কাঠিন্যের মাঝে প্রকৃতির কমনীয়তা আর রমণীয়তা নেই। তাই উপভোগ করার ব্যবস্থাও সীমিত। তবে খুশির মেজাজ যে একেবারে নেই তা নয়। শহরকে নানা রঙ্গে বিচিত্রভাবে সাজাতে ব্যস্ত। শীতের মৌসুমে খেলাধুলার আসর বসে। সার্কাসের আসর বসে শহরতলিতে। বনভোজনের উদ্দেশ্যে ছুটে চলে এক শহর থেকে অন্য কোথাও। চিড়িয়াখানায়, পার্কে ঘুরাফেরা করে। ফলে নতুন করে উজ্জীবিত হয়। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা দামি সুট পরে শীত নিবারণ করে। তবে বস্তি এলাকার নারী, শিশু, মানুষের খুব কষ্ট হয়। তারা কাঁপতে কাঁপতে রোদের জন্য অপেক্ষা করে। গরীবদের অনেক কষ্ট হয়। তাদের দুঃখের যেনো সীমা থাকে না। বস্তির শীর্ণদেহ শিশুদের কথা ভেবেই মনে হয় কবি সুকান্ত লিখেছেন—

“হে সূর্য তুমি উত্তাপ আর আলো দিয়ো,

রাস্তার পাশের উলঙ্গ শিশুটাকে।”

শীতের সকাল উপভোগ ও খাবার-দাবার : শীতের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত হচ্ছে তীর্যক রোদ। চাদর গায়ে দিয়ে বসে গুড়-মুড়ি খাওয়া গ্রামবাংলার এক চিরন্তন দৃশ্য। উজ্জ্বল রোদের শাসনে শীতের সকাল নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে। তা ছাড়া রস, পিঠা, তেলের পিঠা, ভাপা পিঠা ইত্যাদি পিঠাই গ্রামীণ জীবনের শাশ্বত চিত্র। শীতে টাটকা শাকসবজি, নানা জাতের কপি, টমেটো, গাজর, বরবটি, মূলা, পালং, আলু, পিঁয়াজ, রসুন সবই শীতের আচল থেকে বেরিয়ে আসে। এই সুজলা শ্যামল প্রকৃতির নিভৃত গ্রামীণ জীবনে তাই সবজির অভাব থাকে না। শীতের সকালে পাওয়া যায় খেজুরের রস। খেজুরের রসের পায়েস খেতে অপূর্ব লাগে। তাইতো বাংলার খ্যাতনামা মহিলা কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন—

“পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে,

আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে।”

উপসংহার : শহরের কৃত্রিমতার ভারে নুইয়ে পড়া যান্ত্রিক জীবনের মাঝে প্রকৃতির সেই সৌম্য-শান্ত লাস্যময়ী রূপ পাওয়া কঠিন। কারণ, এখানে নেই সেই খেজুরের রস, রসের পায়েস, পিঠা, ভাপাপুলি আর গুড়-মুড়ি, নারকেলের মুড়ি। শীতের সকালকে উপভোগ করতে হলে সৌন্দর্যের ও অনবদ্য মাধুর্যের পশরা দেখতে হলে গ্রামেই সম্ভব। নিশীথ রাত্রির হিমঝরা কুহেলীর স্মৃতি কায়িক অপারগতা একমাত্র গ্রামেই। গ্রামীণ শীতের সকাল আমাদের ঐতিহ্যের চির-আবহমান ধারা। এ ঐতিহ্য নিরবধি বয়ে চলছে আমাদের আবহমান চিরায়ত বাংলায়।

আরও পড়ুন: ছাত্র জীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা রচনা। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url